ফেসবুক মেসেঞ্জার, ওয়াটসঅ্যাপ এর ভিড়ে আপনি কখনো হয়তো টেলিগ্রাম কি ও কেন ব্যবহার করবেন – এ প্রশ্নের উত্তর জানার ইচ্ছে নিয়ে ভাবতে বসেননি। জেনে অবাক হবেন- পৃথিবীর সেরা ৫টি জনপ্রিয় মেসেজিং সার্ভিসের মধ্যে টেলিগ্রাম একটি? অনেকে এটাও বিশ্বাস করেন যে- এটিই বর্তমান বিশ্বের সেরা মেসেজিং অ্যাপ।
কিন্তু কেন ভাবেন? ফেসবুক মেসেঞ্জারের চেয়ে এখানে বাড়তি কি পচ্ছেন তারা আপনার কি জানতে ইচ্ছা করে না? আজ তাই আপনার জন্য টেলিগ্রাম সম্বন্ধিত একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা থাকছে যাতে আপনার ধারণাটি পরিষ্কার করে নিতে পারেন। সাথেই থাকুন।
টেলিগ্রাম কি?
ফেসবুক মেসেঞ্জার কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ এর মতো এটিও একটি মেসেজিং অ্যাপ যা আপনাকে টেক্সট মেসেজিং এর পাশাপাশি ভিডিও কল কিংবা ভয়েস মেসেজিং এর সুবিধাও দিয়ে থাকে। আর এখানে আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় হলো এটি ২ জিবি সাইজের মধ্যে আপনাকে কোনো ফাইল শেয়ার করার সুযোগ দিয়ে থাকে যা সত্যি অনন্য। বর্তমানে সর্বশ্রেষ্ঠদের কাতারে থাকা এই টেলিগ্রাম অ্যাপটি আবিষ্কার করেন রাশিয়ার একজন উদ্যোক্তা প্যাভেল ডিউরভ।
টেলিগ্রাম অ্যাপটির উৎপত্তি হয় কিভাবে?
একটু আগেই বলেছি টেলিগ্রামের উৎপত্তি হয় প্যাভেল ডিউরভ ও নিকোলাই ডিউরভ নামক দু’ভাইয়ের হাত ধরে। কিন্তু এটি আবিষ্কারের ঠিক আগেই তারা একটি অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন।
কাণ্ডটা ছিল কিছুটা এমন-
টেলিগ্রাম আবিষ্কারের ঠিক আগেই দুজনেই রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সোস্যাল নেটওয়ার্ক VKontakteo ছেড়ে দেয় যা একসময় তাদের হাত ধরেই এসেছিল। আর ছেড়ে দেয়ার পর পরই তারা এর চেয়েও বড় কিছু উদ্ভাবনের সিদ্ধান্ত নেয়। যার ফলস্বরূপ ২০১৩ সালেই টেলিগ্রাম অ্যাপটি বানাতে সক্ষম হয়। ঐ বছরেই এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আর দেখতেই দেখতেই সে বছরি তাদের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখে। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০১৪ তে যা ছিল ৩৫ মিলিয়ন।
মাত্র ১ বছরের ব্যবধানেই ৩৪ মিলিয়ন, এত কম সময়ে এত জনপ্রিয়তা হয়তো বা কোনো অ্যাপ এখনো পর্যন্ত পায়নি। আর বর্তমানেও এর জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। যা আমরা এর ৪০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারীর সংখ্যাটা দেখলেই বুঝতে পারি। আর প্রতিনিয়তই এটা বেড়ে চলেছে।
টেলিগ্রাম অ্যাপের জনপ্রিয় কিছু ফিচার-
টেলিগ্রাম অ্যাপটির এত জনপ্রিয়তার পিছনে কারণ কি জানেন? এর অনন্য সব ফিচারগুলো। এ পর্যায়ে তাই টেলিগ্রাম অ্যাপের ফিচার নিয়ে কথা বলব-
১। একাধিক ফোন নাম্বার ব্যবহারের সুবিধা-
মাঝে মাঝেই আমাদের সোস্যাল মিডিয়া একাউন্টগুলোর ফোন নাম্বার পরিবর্তন করার কিছুটা প্রয়োজন পড়ে। আর এসময় সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি হয় তা হলো আগের সিম কার্ডে যে কন্টাক্টগুলো ছিল তা চ্যাটলিস্ট থেকে উধাও হয়ে যায়। আর নতুন করে সব সাজাতে গেলেও প্রায় অনেক সময়ের প্রয়োজন পড়ে। এমতাবস্থায় কি করবেন?
চিন্তা নেই টেলিগ্রাম তো আছেই। হ্যাঁ আপনার উপরোক্ত কাজটি টেলিগ্রাম নিজেই করে দিবে। এতে আপনার কোনো চিন্তা করতে হবে না। সিম চেঞ্জ করার সাথেই সাথেই আপনার সব চ্যাট হিস্টোরি নতুন সিমে চলে যাবে। আর এভাবেই খুব সহজেই আপনি ইচ্ছা মতো আপনার সিম কার্ডটি পরিবর্তন করতে পারেন।
২। কাস্টমাইজিং বা নিজের মতো করে সাজানো-
এটি টেলিগ্রামের অন্যতম একটি জনপ্রিয় ফিচার যা আপনাকে আপনার চ্যাট এরিয়া নিজের মতো করে সাজানোর সুবিধা দিয়ে থাকে। এতে করে যেকোন সময়ই আপনি চ্যাট কালার কিংবা চ্যাট ব্যাকগ্রাউন্ড পরিবর্তন করতে পারবেন, আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী।
৩। টেলিগ্রাম বট-
মাঝে মাঝেই আপনার এমন দরকার পরে যে আপনি চান আপনি না থাকলেও আপনার মেসেজগুলোর রিপ্লাই যেন কেউ না কেউ দেয়। এমতাবস্থায় একটু কোনো সহযোগীর কথা তো ভাবতেই পারেন। তবে বাহির থেকে কাউকে এনে আপনার প্রাইভেসি হুমকির মুখে ফেলবেন না।
আর টেলিগ্রাম থাকতে এই চিন্তা কিসের। হ্যাঁ টেলিগ্রাম বট আপনি না থাকলেও আপনার দরকারি মেসেজ রিসিভ ও ফরওয়ার্ড করতে সক্ষম। সত্যি অনেক দারূণ তাই না?
৪। মেসেজ মিউট-
বর্তমানে আমাদের অন্যতম একটি ঝামেলা বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়া অ্যাপ্লিকেশনের নোটিফিকেশন। মোবাইলে ইন্টারনেট অন করলেই যেন নোটিফিকেশনের ঝড় ওঠে যায়। আর তার বেশিরভাগই মেসেজিং নিয়েই। তো এই সমস্যা দূর করতে আপনার পছন্দ হতে পারে টেলিগ্রাম অ্যাপটিকে। কেননা আপনি আপনার সব ধরনের মেসেজ এখানে মিউট করে রাখতে পারবেন। যার ফলে নোটিফিকেশনের ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবেন।
৫। প্রক্সি সার্ভারের সাথে সংযোগ-
আপনারা সকলেই হয়তো প্রোক্সি সার্ভার বিষয়টার সাথে পরিচিত রয়েছেন। টেলিগ্রামের সাথেও এর কিছুটা পরিচিতি রয়েছে। কেন?
কারণটি টেলিগ্রাম এখনো কিছু দূরবর্তী এলাকায় বিছিন্ন বা নিষিদ্ধ। সেক্ষত্রে আপনি যখন টেলিগ্রাম ব্যবহার করতে যাবেন তখন হয় আপনাকে ভিপিএন কানেক্ট করতে হবে নয়তো আইপি চেঞ্জ করতে হবে। যা একটু ঝামেলার। তবে চিন্তা নেই। টেলিগ্রাম থাকতে আপনাকে কেন ভাবতে হবে?
টেলিগ্রামের সাথেই Use Proxy নামে একটি অপশন রয়েছে যার মাধ্যমে নিষিদ্ধ বা ব্লক এরিয়াতে এটি ব্যবহার করতে পারবেন।
৬। সেভ মেসেজ ফিচার ও ক্লাউড সেবা-
এই ফিচারটি আপনার জন্য একটি অনন্য সুবিধা প্রদান করে থাকে। এর মাধ্যমে আপনার প্রয়োজনীয় ফাইলগুলো আপনি যেকোনো জায়গা থেকে দেখতে পারবেন।
তবে এর জন্য অর্থাৎ মেসেজ সেভ করতে কিন্তু আলাদা কোনো মেমোরি ব্যবহার করতে হবে না। কারণ টেলিগ্রাম আপনার জন্য একটি ক্লাউড সেবা বরাদ্দ রেখেছে। এখানে আপনি আপনার যাবতীয় ফাইল সংরক্ষণ করতে পারেন।
৭। যাত্রাপথে নিজের লাইভ লোকেশন শেয়ারিং-
টেলিগ্রামের অন্যতম একটি ফিচার লোকেশন শেয়ারিং। ধরুন আপনি আপনার এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাবেন। কিন্তু সমস্যা হলো আপনি এই প্রথম তার বাড়িতে যাচ্ছেন। রাস্তাও ঠিক মতো চিনেন না । আবার সাথেও কেউ নেই।
এমতাবস্থায় টেলিগ্রামের লাইভ লোকেশন শেয়ারিং এর মাধ্যমে আপনি আপনার বন্ধুর কাছ থেকে রাস্তার সেই সময়ের বর্ণনা পেয়ে যেতে পারেন। আর খুব সহজেই আপনার যাত্রা পথে পৌঁছে যেতে পারেন।
৮। একইসাথে একাধিক প্রোফাইল পিকচার-
একজন ফেসবুক কিংবা মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীর অনেক বড় একটা আশা হলো একসাথে একাধিক প্রোফাইল পিকচার যুক্ত করা। তারা চায় তারা যাদের সাথে কথা বলে তারা যেন তাদের এই ছবিগুলো একসাথে দেখতে পায়। অনেকেই আবার ফেসবুকে একসাথে অনেক ছবি যুক্ত করা যায় না বলে, কিছুদিন পর পরই প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করে।
তবে সেই যুগের দিন শেষ। টেলিগ্রাম আপনাকে দিচ্ছে একসাথে একাধিক প্রোফাইল পিকচার যুক্ত করার এক অনন্য সুবিধা।
টেলিগ্রাম কেন অন্যদের থেকে একটু আলাদা?
এ পর্যায়ে আসছি টেলিগ্রামের অনন্যতা নিয়ে। আপনার হয়তো মনে আছে একেবারে শুরুতেই আমি বলেছিলাম টেলিগ্রাম অনেকের কাছেই সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ। কিন্তু কেন? তারা কি ফেসবুক মেসেঞ্জার কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন না?
হ্যাঁ তারাও আপনার মতো ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। তবে তাদের কাছে টেলিগ্রামই অত্যধিক জনপ্রিয়। কারণটা কি?
কারণটা আর কিছুই না। এর অনন্য সব ফিচার ও সিকিউরিটি বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার নিশ্চয়তার বিষয়টি।
হোয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রাম এর মধ্যে তুলনা
আপনি যদি পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় মেসেজিং সার্ভিস অর্থাৎ হোয়াটসঅ্যাপ এর দিকে লক্ষ করেন তাদের কিন্তু ১.৩ বিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছে।
টেলিগ্রামের অনন্য ফিচার যেমন Secret chat কিংবা Self Destructing Message এর কাছে হোয়াটসঅ্যাপেরও কিছুটা মিল রয়েছে। কিন্তু আধুনিক দুনিয়ার জনপ্রিয় ডার্কমোড ফিচার কিন্তু এখনো হোয়াটসঅ্যাপে চালু হয়নি। আবার গ্রুপ ক্যাপাসিটির কথা চিন্তা করলেও আপনি টেলিগ্রামের কাছেই বেশি পাচ্ছেন।
সর্বোপরি বলতে পারেন সিকিউরিটি ফিচার ছাড়া হোয়াটসঅ্যাপের চেয়ে অনেকাংশেই এগিয়ে আমাদের টেলিগ্রাম।
মেসেঞ্জার ও টেলিগ্রাম এর মধ্যে তুলনা
এবার আসা যাক মেসেঞ্জারের সাথে। শুরুতেই একটা কথা বলব। সেটি হলো আপনার সকলেই জানেন ইউজারদের ব্যক্তিগত তথ্য পাচারের অভিযোগ কিন্তু মেসেঞ্জার উপর অনেক আগে থেকেই। তারা মেসেঞ্জারের সিকিউরিটির কথা বললেও আসলে কতটুকু দিচ্ছে? এটা জানতে আপনি কয়েকটি প্রতিবেদন পরে নিতে পারেন।
আর সংক্ষেপে আমি মেসেঞ্জার সমন্ধে ফোর্বসের মন্তব্যের একটু সারাংশ বলছি।
মেসেঞ্জার যে বলে তারা ইউজারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এটা পুরোটা ভুল। আসলে তারা এটি নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। যার জন্য এদেরকে বহুবারই ধরা হয়েছে।
নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবলে আপনি কখনোই এটি ব্যবহার করবেন না। তবে টেলিগ্রাম কিন্তু এমনটি নয়। বরং হোয়াটসঅ্যাপের পরেই তারা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ বলে জ্ঞাত। আর এর নিরাপত্তার প্রমাণও আমাদের সামনে অহরহ।
কোনটি ভালো হবে আপনার জন্য?
উপরের আলোচনার মূল কারণটা ছিল আপনাকে বিষয়টা বোঝানো। কোন বিষয়? বিষয়টা হলো মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপের মিলিতরূপই কিন্তু টেলিগ্রাম।
লক্ষ্য করেছেন কি? না করলে একটু করুন। হোয়াটসঅ্যাপের দিকে তাকান। যেখানে ডার্কমোড কিংবা গ্রুপ স্পেস বিষয়টি অনেকটাই পিছিয়ে।
আবার মেসেঞ্জারের ক্ষেত্রে সে জিনিসগুলো থাকলেও তারা নিরাপত্তা ঠিকভাবে দিচ্ছে না। এমতাবস্থায় একটু দেখলেই বুঝতে পারবেন, টেলিগ্রাম কিন্তু উভয় সেবাই খুব ভালোভাবেই দিয়ে যাচ্ছে।
আর এখানে একটি বিষয় বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটি হলো ফাইল শেয়ারিং। মেসেঞ্জারে আপনি সর্বোচ্চ ২৫ ও হোয়াটসঅ্যাপে ১৬ এমবি পর্যন্ত শেয়ার করতে পারবেন।
সুতরাং উপরোক্ত বিষয়গুলো যদি একটু মাথায় রাখেন তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে কেন টেলিগ্রাম আপনার ব্যবহৃত ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের চেয়ে অনেক বেশি ভালো হওয়ার দাবি রাখে।
প্রয়োজন মনে হলে পড়ে নিতে পারেন –