শীত মানেই বাহারি রকমের পিঠা ও বিয়ের আমেজ সাথে চুটিয়ে খাওয়া-দাওয়া ও ভারী সাজগোজ। শীত বুড়ীর আগমনে ঘাসের ওপর ঝলমলে শিশির ফোঁটা আর পথ প্রান্তরে কুয়াশার চাদর,দেরী করে ঘুম থেকে উঠা ও হাতে চায়ের পেয়ালা নিয়ে আড্ডা দেওয়া, বেশ মনোরম ও উপভোগ্য তাই না? কিন্তু অনেকের কাছেই শীত মানে একটা আতঙ্কের নাম!
এসময় গোসলের কথা চিন্তা করলেই কেমন যেনো ঠান্ডা লাগে, অলসতার কারণে ঠিকঠাক পানি খাওয়াও হয় না, দেখা দেয় নানাধরণের অসুখ। সাথে ঠোঁট ফাটা, পা ফাটা ও ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়া তো আছেই!
আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও খাদ্যাভ্যাসে আসে বিশাল পরিবর্তন। এসময় আদ্রতা কম থাকায় আমাদের ত্বক হয়ে যায় শুষ্ক এবং কিছুটা বয়স্ক ও নির্জীব দেখায়।
শীতের বৈরী আবহাওয়ায় ত্বকের অভিযোজন ক্ষমতা অনেকটা কমে যায়। এসময় শরীরের যত্ন না নিলে শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি ত্বকের জেল্লাও দিনদিন হারাতে থাকে।
শীতকালে সবধরনের ত্বকেরই একটু বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয়। এসময় অর্থাৎ শীতে ত্বকের যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে সঠিক পরিচর্যাই আপনাকে রাখবে সুন্দর ও প্রানবন্ত।
কিভাবে শীতে ত্বকের যত্ন নিবেন?
চলুন জেনে নেওয়া যাক –
পরিমাণ মতো পানি পান করুন
শীতের কাঁপুনিতে বেশ কর্মচঞ্চল মানুষটাও কেমন যেনো আলসে হয়ে যায়। কাঁথা কম্বল ছেড়ে যেনো ওঠতেই চায় না! আসলে শীতের আবহাওয়াটাই এমন। এসময় কমবেশি আমাদের সবাইকেই অলসতা ধরে বসে এবং পানি খাওয়ার প্রবণতাও হ্রাস পায়।
শীতে স্বাভাবিকভাবেই শরীর শুষ্ক থাকে। কম পানি পান করায় আরো বেশি শুষ্ক হয়ে যায়। এমন অবস্থায় দেহের বিষাক্ত পদার্থগুলো বাইরে বেরোতে পারে না। ফলে দেখা দেয় দুর্বলতা, চর্মরোগ, ব্রণ, ত্বক জ্বালাপোড়া, হজমের সমস্যা ইত্যাদি।
যেহেতু আমাদের শরীরের ৭০ ভাগের বেশিই পানি, তাই এসময় অলসতা না করে পরিমাণ মতো পানি পান করুন। ঠান্ডা পানি পান করতে ইচ্ছে না করলে হালকা গরম পানিও পান করতে পারেন।
গরম পানি পান করলে ঘাম হয়; যা আমাদের দেহের বিষাক্ত পদার্থগুলো নিষ্কাশনে সাহায্য করে। দেহের রক্ত সঞ্চালন বাড়ার পাশাপাশি ত্বক হয় মসৃণ ও প্রানবন্ত।
সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন
সানস্ক্রিনকে ত্বকের সুরক্ষাকবচ বলা হয়। বাইরে বের হওয়ার সময় মেকআপ বাধ্যতামূলক না হলেও সানস্ক্রিন কিন্তু বাধ্যতামূলক! সানস্ক্রিন ব্যবহার না করলে সানবার্ন থেকে শুরু করে বলিরেখা, কালোছোপ, এমনকি ত্বকের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
শীতকালে আদ্রতা কম থাকায় ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। আর এই সুযোগেই সূর্যের ইউভি রশ্মি ত্বকের বারোটা বাজিয়ে দেয়! কিন্তু অনেকেরই ভ্রান্ত ধারণা থাকে শীতে সানস্ক্রিন ব্যবহার না করার বিষয়ে।
গ্রীষ্ম হোক বা শীত, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি সব ঋতুতেই বিরাজ করে। তাই শীতেও সানস্ক্রিন ব্যবহার করা জরুরী। বাইরে বেড়োনোর আধঘন্টা আগে সানস্ক্রিন লাগান। সানস্ক্রিন কেনার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যাতে সেটি এসপিএফ ১৫-৩০ যুক্ত সানস্ক্রিন হয়।
আরও পড়ুন-
- রং ফর্সাকারী ক্রিম ছাড়াই ত্বক সুন্দর ও প্রাণবন্ত রাখার ৫টি প্রোডাক্ট
- মেয়েদের মুখের অবাঞ্ছিত লোম তোলার উপায় এবং চিকিৎসা
- ১৩টি কার্যকর পদ্ধতি ব্যবহার করে চুল সোজা করার উপায়
ত্বক ময়েশ্চারাইজ করুন
শীতে ত্বক ময়েশ্চারাইজ রাখা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এসময় অনাদ্র আবহাওয়ায় আমাদের ত্বক রুক্ষ হয়ে যায় এবং বয়স্ক বয়স্ক লাগে। তাই প্রতিবার মুখ ধোয়ার পর ত্বকের ময়েশ্চার ধরে রাখার জন্য ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা অপরিহার্য।
ময়েশ্চারাইজার আমাদের ত্বককে শুষ্ক হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচায় ও ত্বকের আদ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তৈলাক্ত হোক বা শুষ্ক, সব ধরনের ত্বকেই ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত। এটা ব্যবহার করার ফলে, আমাদের ত্বকে এক্সট্রা লেয়ার তৈরি হয়; যা বাইরের ধুলোবালি ও জীবাণু থেকে ত্বককে রক্ষা করে। ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করার ফলে ত্বকের রুক্ষতা, বলিরেখা, সানবার্ন/সানট্যান ও বয়সের ছাপ খুব সহজেই দূর হয়ে যায়।
গ্রীষ্মকালে মুখের ময়েশ্চারাইজার নিশ্চিত করে সারা শরীরের ময়েশ্চারাইজিং স্কিপ করলেও হয়। তবে শীতে মুখের পাশাপাশি শরীরেও ময়েশ্চারাইজিং কিন্তু মাস্ট! এক্ষেত্রে আমরা অধিকাংশ মানুষই লোশন পছন্দ করি।
তবে লোশন দেওয়ার পর নখ দিয়ে হালকা আচড় টানলে খেয়াল করে থাকবেন সেখানে সাদা রেখার মতো দাগ হয়ে গেছে। এটাই প্রমাণ করে যে, আপনার ত্বক ভালোভাবে হাইড্রেট বা ময়েশ্চারাইজ হয়নি।
এ সমস্যা থেকে বাঁচতে, লোশনের সাথে আর্মন্ড বা অলিভ অয়েল মিশিয়ে ব্যবহার করুন। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, এভাবে ব্যবহার করলে পুরো শীত জুড়ে আপনার ত্বক থাকবে এক্সট্রা মোলায়েম ও এক্সট্রা ঝলমলে!
ঠোঁট ও পায়ের প্রতি যত্নশীল হন
শীতে ঠোঁট ও পা ফাটার অন্যতম কারন হলো শুষ্ক আবহাওয়া। শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় ধুলোবালি বেশি থাকে। যার কারনে শরীরে ময়লা জমে ও ত্বক হয়ে যায় রুক্ষ, শুষ্ক।
ত্বক ফাটার আরো অনেকগুলো কারণ আছে। যেমনঃ গরম পানীয় খাওয়া (কফি, চা), জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজানো, হরমোনজনিত সমস্যা, ইউভি রশ্মি ও ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-বি২, ফ্যাটি অ্যাসিড, জিংক ইত্যাদির অভাব।
ঠোঁট ফাটা রোধে যা করবেন –
০১। শীতের সময় পানি পানে অধিকাংশ মানুষই আলস্যবোধ করেন, বা ঠান্ডা থাকায় পান করতে চাননা। ঠিক এই কারণে শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। আর পানিশূন্যতার কারণেই নানাধরণের ত্বকের সমস্যা সৃষ্টি হয়। তাই দৈনিক ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
০২। শীতে ম্যাট বা শুষ্ক লিপস্টিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। এগুলো ঠোঁটকে অনেকবেশি শুষ্ক করে ফেলে।
০৩। ঠোঁটের চামড়া ওঠানো থেকে বিরত থাকুন ও জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাবেন না।
০৪। কিছুক্ষন পরপর লিপবাম বা ভ্যাসলিন ব্যবহার করুন।
০৫। ভ্যাসলিন ব্যবহারে ত্বক কিছুটা কালচে হয়ে যেতে পারে। ত্বক কোমল ও গোলাপি রাখতে চাইলে ৩-৪ চামচ আর্মন্ড অয়েল ( বাদাম তেল), ২চামচ মধু ও ১ চামচ অ্যালোভেরা জেল একত্রে মিশিয়ে একটি কৌটাতে সংরক্ষণ করুন।
তুলোতে এক ফোঁটা গ্লিসারিন ও ২/৩ ফোঁটা পানি মিশিয়ে ঠোঁটে হালকা রাব ( ঘষুন) করুন। ২-৩ মিনিট ঘষার পর ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে ফেলুন। এরপর উক্ত মিশ্রণটি লাগান। এই মিশ্রণটি একবার বানিয়ে পুরো শীত জুড়ে ব্যবহার করতে পারবেন। এটি ব্যবহারে আপনার ঠোঁট থাকবে উজ্জ্বল, নরম ও গোলাপি।
পা ফাটা রোধে করনীয়
দেহের অন্যসব ত্বকে তৈলগন্থি রয়েছে। কিন্তু পায়ের তালুতে কোনো তৈলগন্থি নেই। আছে শুধু ঘর্মগন্থি। শীতে ঘাম না হওয়ায় পায়ের তলার আদ্রতা নষ্ট হয়ে পা অনেকবেশি শুষ্ক হয়ে যায়। যে কারণে শীতে সচরাচর আমাদের পা ফেটে যায়। পা ফাঁটা রোধেও পরিমাণ মতো পানি পান করুন এবং-
০১। বেশি ঠান্ডা আবহাওয়ায় মোজা পরিধান করুন।
০২। গোসলের পর পায়ে অলিভ অয়েল ম্যাসাজ করুন।
০৩। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পায়ে গ্লিসারিন মালিশ করে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগান। এরপর মোজা পরে ঘুমিয়ে পরুন। এতে করে পা দ্রুত গরম হবে ও পা ফাঁটা সপ্তাহখানেকের মধ্যেই কমতে শুরু করবে।
০৪। যাদের পা ফাঁটা অনেক বেশি, তারা গরম পানির মধ্যে ১৫ মিনিটের মতো পা ভিজিয়ে রাখুন। পরে একটু শুকনো কাপড় দিয়ে ভালোভাবে পা মুছে নিন। এরপর ১চামচ লেবুর রস, ৩-৪ ফোটা গ্লিসারিন ও পরিমাণ মতো ভ্যাসলিন একসাথে মিশিয়ে মিশ্রণটি ভালোভাবে পায়ে লাগান। দ্রুত ফলাফল পেতে প্রতি রাতে ব্যবহার করুন। এটি পা ফাঁটা রোধ করার জন্য একটি কার্যকরী উপায়।
০৫। যাদের পা অনেক বেশি ফেটে গেছে, মেঝেতে পা রাখলে ব্যাথা অনুভূত হয় বা রক্ত বের হয়, তারা খামখেয়ালি না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
চুল খুশকি মুক্ত রাখুন
আলোচনা করছিলাম শীতে কিভাবে ত্বকের যত্ন নিবেন সে বিষয়। কিন্তু এখানে চুলের কথা কেনো টেনে আনলাম নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে, তাই না? হ্যাঁ বলছি।
মাথার খুশকি মুখের ওপর পরলে মুখে ব্রণ দেখা দেয়। ঘাম, তেল, ছত্রাক, মৃত কোষ সব মিলিয়েই খুশকি। আর এগুলো ত্বকের ওপর যখন পরে তখন ব্রণ দেখা দেওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।
শীতে একটু অযত্নের কারণে খুশকি আপনার সুন্দর চুল ও সুন্দর মুখটিকে নিমিষেই অসুন্দর করে দিতে পারে। শীতে খুশকি হয় না এমন উদাহরণ খুবই বিরল। শীতে আদ্রতা কম থাকায় চামড়া শুকিয়ে যায়।
এছাড়া অনেকেই আছেন শীতকালে দুই তিন দিন পর পর গোসল করেন। আবার অনেকেই আছেন শীতে মাথা ভালো করে ভেজান না । চুল নিয়মিত পরিষ্কার না করলে মাথায় ফাঙ্গাস হয়।
ফাঙ্গাস থেকেও চুলে খুশকি হয়ে থাকে। এছাড়াও শীতে পানি পানের প্রবনতা কমে যায়, যার কারণে খুশকি হয়। তাই ব্রণ হওয়ার মতো বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচতে শীতে ত্বকের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি চুলেরও যত্ন নিন।
এখন আশা যাক-
শীত মৌসুমে চুলের খুশকি দূর করার উপায়
০১। চুলে বেশি গরম পানি ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
০২। পরিমাণ মতো পানি পান করুন ও কমলার রস খান।
০৩। পরিমাণ মতো নিমপাতা ব্লেন্ড করে নিন এরপর মাথার স্কাল্পে খানিকটা লবন ম্যাসাজ করে নিন। এরপর নিমের মিশ্রণ ২০-৩০ মিনিটের মতো রেখে শ্যাম্পু করে নিন। চুল খুশকি মুক্ত রাখতে এ মিশ্রণটি সপ্তাহে ১ বার ব্যবহার করুন। বেশি খুশকি হয়ে থাকলে সপ্তাহে ২-৩ বার ব্যবহার করুন।
০৪। এছাড়াও ৫-৬ চামচ লেবুর রস, ২ চামচ পেয়াজের রস, এক চামচ লবণ একসাথে মিশিয়ে মাথায় ভালোভাবে লাগিয়ে আধঘন্টা অপেক্ষা করে ধুয়ে ফেলতে পারেন। সপ্তাহে ২ বার। এতেও বেশ ভালো উপকার পাবেন।
প্রয়োজন মনে হলে পড়ে দেখতে পারেন-