বিজ্ঞান হল প্রকৃতি সম্ভূত প্রকৃষ্ট জ্ঞান, যা শ্বাশত, যা অপরিবর্তনীয়, প্রকৃতির শক্তির ক্রিয়া ধারায় তা প্রকাশিত। সেই সব ঘটনা পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও সেই সব ঘটনা পরম্পরার সঙ্গে সম্পর্ক আবিষ্কারই হল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে কোন বিষয় সম্পর্কে বিধিবদ্ধ জ্ঞানই বিজ্ঞান।
হোমিওপ্যাথি যে প্রকৃত বিজ্ঞান সম্মত তাতে কোন সন্দেহ নেই। রোগের ঘটনা সম্পর্কে বিধিবদ্ধ জ্ঞান হল রোগ বিজ্ঞান। ঔষধ সম্বন্ধে বিধিবদ্ধ জ্ঞানই হল ভেষজ বিজ্ঞান। আর কোন নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে রোগের চিকিৎসা ও নিরাময় করার বিধিবদ্ধ জ্ঞানই হল আরোগ্য বিজ্ঞান।
হোমিওপ্যাথির তত্ত্ব ও প্রয়োগ পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে রচিত হয়েছে।
হোমিওপ্যাথি একটি সুসংঘটিত নিয়মতান্ত্রিক চিকিৎসা পদ্ধতি যার মূল তত্ত্ব হল সুস্থাবস্থায় কোন ঔষধ স্থুলমাত্রায় সেবন করলে মানব দেহে ও মনে যে সকল অসুস্থকর লক্ষণ প্রকাশ পায়, ঐ প্রকার লক্ষণযুক্ত প্রাকৃতিক অসুস্থতায় উক্ত ঔষধের শক্তিকৃত সূক্ষমাত্রা প্রয়োগে রোগলক্ষণ দূরীভূত হয়ে যায়। এটা প্রাকৃতিক নীতি সম্মত।
মহাত্মা হ্যানিম্যান সুস্থ দেহে কুইনিন সেবন করে ম্যালেরিয়া হতে দেখলেন এবং কৌতুহল বশতঃ আরও অনেকগুলো ঔষধের স্থুলমাত্রা সুস্থদেহে গ্রহণ করে বুঝতে পারলেন যে, ঔষধের কৃত্রিম রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা রয়েছে।
আবার ঐ সকল ঔষধের সূক্ষমাত্রা ব্যবহার করে ঔষধের লক্ষণ দূরীভূত হওয়ার ঘটনাও স্বয়ং প্রত্যক্ষ করলেন।
সুতরাং এই গবেষণা হতে প্রমান হয়, সকল শক্তিশালী ভেষজের কৃত্রিম রোগ সৃষ্টির ক্ষমতা এবং শক্তিকৃত অবস্থায় আরোগ্যকর ক্ষমতা আছে; এটা সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ভিত্তিক।
এটি গবেষণালব্ধ সত্য যে ঔষধ সুস্থ দেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে, সেই ঔষধ অনুরূপ লক্ষণবিশিষ্ট প্রাকৃতিক পীড়া আরোগ্য করতে পারে। ইহাই “Similia Similibus Curentur” – সদৃশ রোগ সৃজনক্ষম ঔষধ দিয়েই আরোগ্য সাধন সম্ভব।
হোমিওপ্যাথি যে বিশুদ্ধ আরোগ্য বিজ্ঞান সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
বিজ্ঞানের সাধারণ নীতিগুলোর সঙ্গে হোমিওপ্যাথির বিধানসমূহ সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ। বিজ্ঞানের যে নীতিগুলোর সঙ্গে এর সামঞ্জস্য আছে সেগুলো হলঃ
(ক) এই বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ড এক বিরাট শক্তিপিণ্ড বিশেষ। জীব ও জড় এই উভয় পদার্থে সেই শক্তি বিদ্যমান।
(খ) জড় পদার্থ হল শক্তিরই স্থুলরূপ। পদার্থ ও শক্তি আপেক্ষিক সূত্র দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে আবদ্ধ।
(গ) পদার্থকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রূপে বিভাজন করা চলে, কিন্তু ধ্বংস করা চলে না।
(ঘ) একই পদার্থের যা বৃহৎ মাত্রায় কর্মক্ষমতার ক্ষতি বা ধ্বংস সাধন করে তাহাই ক্ষুদ্র মাত্রায় উদ্দীপন করে।
(ঙ) উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়া এবং আত্মরক্ষা করার স্বতঃস্ফূর্ত প্রয়াস চালানো সজীব পদার্থের স্বাভাবিক ধর্ম।
(চ) আরোহনীতিঃ কোনরূপ অনুমান বা কল্পনার আশ্রয় না নিয়ে বাস্তব ঘটনাসমূহের পর্যবেক্ষণ, বিশ্লষণ ও ঘটনাসমূহের মধ্যে সম্পর্কের এক সাধারণ সূত্র আবিস্কার করা যা প্রতিটি ঘটনার বেলায় প্রযোজ্য এবং সেই সঙ্গে বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
(ছ) প্রতিটি ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়া বিরামহীনভাবে চলে।
(জ) শক্তির প্রবাহ হল কেন্দ্র হতে পরিধির দিকে। ভিতর হতে বাহিরের দিকে।
যুক্তিশাস্ত্রের আরোহনীতি ও অবরোহনীতি অনুসরণ করে ঘটনা সমূহের মধ্যে কোন সাধারণ নিয়মের আবিস্কার করা এবং তা পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা করে তার সত্যতা ও সার্বজনীনতা যাচাই করে নেওয়ার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর হোমিওপ্যাথি প্রতিষ্ঠিত।
আরোহনীতির মূল কথা হল ঘটনা সমূহের যথাযথ পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, ঘটনাসমূহের পরস্পরের সম্পর্ক ও কারণ সম্পর্কে এবং সাধারণ সূত্র আবিস্কার করা যা প্রতিটি ঘটনার বেলায় প্রযোজ্য হবে।
অবরোহ পদ্ধতির মূল কথা হল কোন নিয়ম যদি সাধারণভাবে এক বিশেষ শ্রেণীতে সত্য বলিয়া প্রতিয়মান হয় তবে সে শ্রণীর প্রত্যেকের বেলায়ও সে নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
হোমিওপ্যাথির বিভিন্ন ঔষধ বিভিন্ন সময়ে সেস্থ মানব দেহে প্রয়োগ করে দেখা গিয়েছে যে, ঐ ঔষধগুলো সর্বক্ষেত্রে একই ধরণের দৈহিক ও মানসিক লক্ষণ সৃষ্টি করে।
আবার সেই ঔষধেরই সুক্ষমাত্রা সেইরূপ লক্ষণযুক্ত রুগ্ন মানুষে প্রয়োগ করলে সেই লক্ষণগুলো দূরীভূত হয়ে যায় এবং রোগী স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পায়।
উপরোক্ত আলোচনা হতে নিঃসন্দেহে প্রমান হয় যে, হোমিওপ্যাথির প্রতিটি নীতি বিজ্ঞানের নীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। তাই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শাস্ত্র বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত নয়, ইহা এক বৈজ্ঞানিক আরোগ্য বিজ্ঞান।