যৌবনাবস্থার সূচনায় স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের মুখমন্ডল, পৃষ্ঠ, স্কন্ধদেশ, নাসিকা এবং চিবুকে, কখনও দু-চারটি, কখনও শত শত বয়ঃব্রণ প্রকাশ পায়। এই ধরণের মুখের ব্রণ সমগ্র মুখমন্ডল তথা মুখের সার্বিক সৌন্দর্যের যথেষ্ট ক্ষতি করে। আপনি জেনে আনন্দিত হবেন, হোমিওপ্যাথি মতে কার্যকর ও স্থায়ীভাবে মুখের ব্রণ দূর করার ঔষধ (Acne removal treatment) আছে।
হোমিওপ্যাথি মতে মুখের ব্রণ বা একনি দূর করার ঔষধ (Acne removal treatment)
তবে সে বিষয়ে বলার আগে আসুন একবার জেনে নিই, শরীরের বা মুখের বয়ঃব্রণ আসলে কি ও কেন হয়?

মুখের ব্রণ এক প্রকার চর্মরোগ। এই পীড়া সাধারণত চার প্রকার-
১। একনি ভালগারিস (Acne Vulgaris) অথবা সামান্য বয়ঃব্রণ
এইগুলি দুই আঙ্গুল দিয়ে চাপ দিলে এদের মধ্য হতে ভাতের মত মেদ বের হয়। এইগুলির আকারও ক্ষুদ্র হয়।
২। একনি ইন্ডুরেটা (Acne Indurata) অর্থাৎ কঠিন বয়ঃব্রণ
এইগুলি সাধারণ বয়ঃব্রণ অপেক্ষা কঠিন এবং অতি ধীরে ধীরে বর্ধিত হয়। এগুলিতেও পুঁজ সঞ্চার হয় এবং সময়ে সময়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্ফোটকের আকার ধারণ করে। এইগুলি হতে পুঁজ বের হয়ে গেলে দাগটি থেকে যায়।
৩। একনি রেজিওলা (Acne Regiola) বা আরক্ত বয়ঃব্রণ
এই ব্রণগুলি উজ্জ্বল লালবর্ণ হয় এবং আশপাশের শিরাগুলি স্ফীত হয়। এই রোগ সহজে আরোগ্য হতে চায় না।
৪। একনি টিউবারকুলেটা (Acne Tuberculata)
অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে ২৫ হতে ৫০ বৎসর মধ্যে আর এক প্রকার বয়ঃব্রণ জন্মে। এদেরকে একনি টিউবারকুলেটা বলে। এগুলো আকারে গুটিকার ন্যায় বড় হয় বলে এদের এরুপ নাম দেয়া হয়েছে। একনি টিউবারকুলেটা সাধারণত পুরুষদেরই হয়ে থাকে। তবে জরায়ু ও ডিম্বকোষের ক্রিয়ার বৈলক্ষণে স্ত্রীলোকদেরও হতে পারে।
মুখে অথবা শরীরে বয়ঃব্রণ হবার কারণ
এই পীড়ার সাধারণ কারণ উত্তেজক বস্তুর সংস্পর্শ। সহজভাবে বললে, কসমেটিক, ক্রীম প্রভৃতির অতি ব্যবহার, পরিচ্ছন্নতার অভাব, শরীরে অত্যন্ত গরম বা ঠান্ডা লাগান প্রভৃতি। কিন্তু কোষ্ঠবদ্ধতা ও গুরুপাক দ্রব্যাদি খেয়ে অন্ত্রের উত্তেজনা ঘটানও এর একটি প্রধান কারণ। যুবকদের এই পীড়া হবার মূল কারণ প্রায়ই হস্তমৈথুন ও অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়সেবা। নারীদেরও জরায়ু ও ডিম্বকোষের পীড়া হতে এই রোগ জন্মাতে পারে।
এই রোগের ভাবিফল কিন্তু সাংঘাতিক নয়। তবে মুখের ব্রণ যে যুবক-যুবতীর মুখশ্রী যথেষ্ট পরিমাণে খারাপ করে দেয় সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। রোগীকে প্রায়ই ৬ থেকে ৭ বৎসর এই পীড়ার যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।
কমেডোনস (Comedones)
কমেডোনসও একটি বয়ঃব্রণ সদৃশ ব্যাধি। স্ফোটকগুলির মাথার উপর একটি কাল বিন্দুর ন্যায় দাগ থাকে বলে একে Black-heads বলা হয়। চর্মের রস-শ্লেষ্মা স্রাবী গহ্বরগুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লাল বা হরিদ্রাবর্ণ স্ফোটক জন্মে।
ঐগুলি টিপলে বয়ঃব্রণের মত ভাতের ন্যায় পদার্থ বের হয়। কিন্ত পীড়িত স্থানটি সামান্য উঁচু হয়ে থাকে। সচরাচর এই পীড়া নাক, মুখগহ্বরের নিকটবর্ত্তী স্থান এবং চিবুকে দেখা যায়। কখনও কখনও এটা পিঠ ও পুরুষাঙ্গেও প্রকাশ পায়। এই পীড়া ও বয়ঃব্রণ অনেক সময়ে একসাথে প্রকাশ পায়।
এর উৎপত্তির কারণও হজমশক্তির ক্ষীণতা, কোষ্ঠবদ্ধতা, ঋতুস্রাবের গোলযোগ, হস্তমৈথুন প্রভৃতি। রোগীর যৌবনারম্ভ হতে ৩০ বৎসর বয়স পর্যন্ত এই পীড়া হতে দেখা যায়। এর চিকিৎসা ও বয়ঃব্রণের চিকিৎসা একই প্রকার।
স্থায়ীভাবে মুখের ব্রণ বা একনি দূর করার ঔষধ (Acne removal treatment)
এই পীড়ার চিকিৎসা বলতে দুইটি বিষয় বুঝায়। বর্তমান ব্রণের গুঁটিগুলোকে দূর করা। দ্বিতীয়তঃ ভবিষ্যতে যাতে আর ব্রণ প্রকাশ না পায় তার ব্যবস্থা করা।
ডাঃ বেয়ার বলেছেন- বয়ঃব্রণ রোগ আরোগ্য করা অত্যন্ত কঠিন কারণ যুবক-যুবতীগণ প্রায়ই আহার বিহার সম্বন্ধে কোন নিয়ম মেনে চলতে চায় না।
এইরুপ রোগীদের অনেকের পক্ষে চর্বি জাতীয় দ্রব্য, মাংস প্রভৃতি পরিত্যাগ করা উচিত। চা, কফি, পান অতিরিক্ত মসলা ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতিকারক হয়। স্নিগ্ধ জলে স্নান এবং ভালভাবে শরীর কচলিয়ে গোসল করলে রক্ত সঞ্চালনের উন্নতি হয়। এতে বয়ঃব্রণ প্রকাশ পাবার স্বভাবটি কমে আসে।
আভ্যন্তরিক ঔষধ প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা একান্তই প্রয়োজন। কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা আন্ত্রিক গোলযোগ থাকলে এই পীড়া কখনই আরোগ্য হবেনা।
নারীদের ঋতুস্রাবের গোলযোগ থাকলে স্বতন্ত্রভাবে তার চিকিৎসা করাও আবশ্যক। এইরূপ মুখের ব্রণযুক্ত রোগী অধিক ক্ষারযুক্ত সাবান ব্যবহার করবেন নাা। কোন প্রকার কসমেটিক্স জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
মুখের ব্রণ দূর করার সর্বাধিক কার্যকরী হোমিওপ্যাথিক ঔষধ
বার্বেরিস একুইফোলিয়াম Q
বয়ঃব্রণ রোগ দীর্ঘদিনের হলে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরিকভাবে “বার্বেরিস একুইফোলিয়াম” ঔষধটি বিশেষ উপযোগী বলে প্রমাণিত হয়েছে।
Dr. Dewey বলেন, “যেখানে চামড়া কর্কশ হয়ে যায় এবং বয়ঃব্রণ কিছুতেই আরোগ্য হতে চায় না, সেখানে বার্বেরিস একুইফোলিয়াম উপযোগী। ডাঃ বোরিকও ঔষধটির বিশেষ প্রশংসা করেছেন। ঔষধটির মূল অরিস্ট ১ থেকে ২ বিন্দু মাত্রায় দিনে ২ বার খেতে হবে এবং বাহ্যিকভাবে তুলায় করে লাগাতে হবে।
ডাঃ ডাব্লিউ. এ. ডিউই নিম্নলিখিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধগুলি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন-
সালফার ২০০ – পুরাতন রোগীদের জন্য উপযোগী।
স্যাঙ্গুইনেরিয়া ৩০ – যে সকল নারীদের অল্প ঋতুস্রাব হয় এবং যাদের রক্ত সঞ্চালন ক্ষীণ তাদের জন্য প্রয়োজন।
ক্যালকেরিয়া কার্ব ২০০ – শীতকাতর ও ঘর্মপ্রধান রমনীদের যৌন সম্ভোগপ্রবৃত্তি দমন করে রাখার কারণে বয়ঃব্রণ হলে ভাল কাজ করে।
অরাম মিউর নেট্রোনেটাম ৩X – বাত-ব্যথা ও জরায়ুপীড়াগ্রস্থ স্ত্রীদের চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে।
কেলি ব্রোম ৩০ – এই ঔষধটি মুখমন্ডল, গ্রীবাদেশ ও স্কন্ধে বয়ঃব্রণ সৃষ্টি করে থাকে। সাধারণ মুখের ব্রণ ও চর্মস্ফীতিযুক্ত বয়ঃব্রণের পক্ষে একটি উৎকৃষ্ট ঔষধ। কেলি ব্রোমেটাম অতিরিক্ত কামচর্চা ও হস্তমৈথুনকারী ব্যক্তদের বয়ঃব্রণ চিকিৎসায় কার্যকরি একটি শ্রেষ্ঠ ঔষধ।
ডাঃ এ. এম. কাশিং বলেছেন- আর্সেনিক ব্রোমেটাম ৪X অপর একটি অত্যুৎকৃষ্ট ঔষধ।
থুজা অক্সিডেন্টালিস ২০০ – মুখের ব্রণ -এর একটি ভাল ঔষধ।
ক্যালকেরিয়া পিক্রটা ৩X – যুবকদের বয়ঃব্রণ চিকিৎসায় কার্যকরী। মুখে পুঁজযুক্ত বা রক্তের ছিটযুক্ত ফুস্কুড়ি জন্মাতে থাকলে ক্যালকেরিয়া সালফ ১২X ভাল কাজ করে।
এন্টিম ক্রুড ৩০ – বয়ঃব্রণগুলি লাল বর্ণ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র। ঐগুলো মুখমন্ডলের উপরেই বিশেষভাবে প্রকাশ পায়। মাতালদের ও পাকাশয়িক গোলযোগযুক্ত ব্যক্তি যাদের জিহ্বায় ঠিক দুধের মত সাদা লেপ থাকে, তাদের মুখের ব্রণ চিকিৎসায় অধিক কার্যকারিতার সাথে ব্যবহার হয়।
নেট্রাম মিউর ২০০– শুষ্ক চেহারা, কাঁচা লবণ খেতে ভালবাসে এবং স্নানে উপশম পায় এরুপ ব্যক্তির পক্ষে উপকারী।
এই রোগ চিকিৎসা করতে হলে রোগীর প্রকৃতি, তার উপশম, উপচয়, সাধারণ লক্ষণগুলির দিকে স্থানীয় লক্ষণ অপেক্ষা অধিক দৃষ্টি দিতে হবে।
আরও পড়ুন-