উগান্ডা শব্দটি শুনলে হয়তো আপনার মাথায় খেলা করে চরম দরিদ্রতায় ভোগা একটি দেশের ছবি৷ অথবা চোখে ভেসে উঠে সাধাসিধে কালো মানুষের চওড়া হাসিমুখ। তবে সত্যটা হচ্ছে আমরা বেশিরভাগ মানুষই এই দেশটি সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানিনা। প্রচলিত তথ্যগুলোর বাইরে আসলে কি আছে উগান্ডায়? চলুন জেনে নেওয়া যাক উগান্ডা দেশটির আদ্যোপান্ত!
উগান্ডার অবস্থান ও জলবায়ু
উগান্ডা পূর্ব-মধ্য আফ্রিকার একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। উগান্ডার সরকারী নাম “রিপাবলিক অফ উগান্ডা”। দেশটির পূর্বে কেনিয়া, উত্তরে দক্ষিণ সুদান, পশ্চিমে কঙ্গোর গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ-পশ্চিমে রুয়ান্ডা এবং দক্ষিণে তানজানিয়া অবস্থিত। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিখ্যাত লেক ভিক্টোরিয়ার একটি বড় অংশ রয়েছে। এটি কেনিয়া এবং তানজানিয়ার সাথে উগান্ডাকে ভাগ করেছে। দেশটি নীল নদের অববাহিকা অঞ্চলের অংশ।
উগান্ডার জলবায়ু অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। সাভান্না তৃণভূমি, ঘন জঙ্গল, উঁচু পর্বত ও আফ্রিকার বৃহত্তম হ্রদ ভিক্টোরিয়া হ্রদের অর্ধেকের বেশি অংশ এ দেশে অবস্থিত।
উগান্ডা বিষুবরেখার উপর অবস্থিত হলেও উচ্চতার কারণে এখানকার জলবায়ু তুলনামূলকভাবে মৃদু। ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি এবং জুন-জুলাই মাসে এখানে দুইটি শুষ্ক মৌসুম দেখা যায়। গাছের প্রতি উগান্ডার মানুষের আবেগ অতুলনীয়। একটি গাছ কেটে ফেলার পর এখানকার মানুষকে প্রচলিত শাস্তি হিসেবে তিনটি গাছের চারা রোপন করতে হয়।
উগান্ডার ইতিহাস
উগান্ডা নামটি এসেছে প্রাচীন বুগান্ডা রাজ্য থেকে। প্রাচীন এই বুগান্ডা রাজ্যটি রাজধানী কাম্পালাসহ দেশের দক্ষিণের এক বিরাট অঞ্চলকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল। উগান্ডার আদিম লোকেরা প্রায় দুইহাজার বছর আগে শিকারি ও পশু সংগ্রহের পেশায় জড়িত ছিল। তখন বান্টু ভাষাভাষী লোকজন মধ্য আফ্রিকা ও পশ্চিম আফ্রিকা থেকে উগান্ডার দক্ষিন অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করে।
এই জনগোষ্ঠীর লোকদের লোহার কাজ সম্বন্ধে বিশেষ জ্ঞান ছিল এবং তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসমূহের নীতিগুলোও জানতো। এই সাম্রাজ্যের পতনের পরে দেশটিতে উত্থান ঘটে বুনিইওরো-কিতারা, বুগান্ডা এবং আনকোলে সম্রাজ্যের। পরবর্তী শতকগুলোতে এভাবেই ক্ষমতার পালাবদল অব্যাহত ছিল।
উগান্ডায় উনিশ শতকের শেষের দিকে উগান্ডায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের আগমন ঘটে। তবে এর পূর্বে এখানে অনেকগুলি শক্তিশালী রাজত্ব ছিল। এদের মধ্যে বুগান্ডা ও বুনিয়োরো উল্লেখযোগ্য। ১৮৯৪ সালে উগান্ডা একটি ব্রিটিশ প্রোটেক্টোরেটে পরিণত হয়। ১৯২৬ সালে উগান্ডার বর্তমান সীমানাটি নির্ধারিত হয়। ১৯৬২ সালে এটি ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।
পরবর্তীতে উনবিংশ শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকের শুরুর দিকে ইদি আমিন ও মিল্টন ওবোতের স্বৈরশাসনের সাক্ষী হয় উগান্ডা। এ সময়ে উগান্ডা ২বার যুদ্ধের শিকার হয়। ১৯৮৬ সালে বাস্তবদাবাদী নেতা ইয়োওয়েরি মুসেভেনির অধীনে উগান্ডায় স্থিতিশীলতা আসে। প্রেসিডেন্ট মুসেভিনি মূলত উগান্ডাতে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার চালু করেন।
উগান্ডার ভাষা ও রাজধানী
উগান্ডার মানুষ প্রায় ৩০টির বেশি ভাষায় কথা বলেন। তবে উগান্ডার সরকারী ভাষা দুইটি- ইংরেজি এবং সোয়াহিলি। এদের মধ্যে সোয়াহিলি ভাষা আফ্রিকান ইউনিয়নের দাপ্তরিক ভাষাগুলির মধ্যে একমাত্র আফ্রিকান ভাষা। উগান্ডার পাশাপাশি এই ভাষাটি সারাবিশ্বে প্রায় ৪ টি দেশের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।
উগান্ডার রাজধানীর নাম কাম্পালা। এটি উগান্ডার বৃহত্তম শহর। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে অবস্থিত উন্নয়ন পরামর্শক সংস্থা “মারছার” কাম্পালাকে পূর্ব আফ্রিকায় বসবাসের জন্য সেরা শহর হিসেবে অভিহিত করেছে। অর্থাৎ বসবাসের জন্য নাইরোবি ও কিগালি থেকে এগিয়ে রয়েছে উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা। দেশটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক ভবন এই শহরটিতেই অবস্থিত।
উগান্ডার আয়তন ও জনসংখ্যা
পূর্ব আফ্রিকার দেশ উগান্ডার আয়তন প্রায় ২ লাখ ৪১ হাজার ৩৮ বর্গকিলোমিটার। দেশটিতে জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ২৮ লাখ। আয়তনের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের ৭৯তম দেশ। উগান্ডার জনসংখ্যা স্বাধীনতার পর থেকে দ্রুত বেড়েছে। ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সময় উগান্ডার জনসংখ্যা ছিল প্রায় প্রায় ৭০ লক্ষ। এখন সেই সংখ্যাটি তিনগুণেরও বেশি। আফ্রিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশগুলির মতো উগান্ডার জনসংখ্যাতেও মূলত তরুণ বয়সীদের আধিক্য। ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। এছাড়া উগান্ডায় ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণের সংখ্যা প্রায় এক-চতুর্থাংশেরও বেশি।
উগান্ডার মানুষের ধর্ম ও জাতীয়তা
উগান্ডা ধর্মীয় দিক থেকে বৈচিত্রময় একটি দেশ। উগান্ডার মানুষ মূলত খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। এখানকার প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী। এছাড়া উগান্ডায় মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ১৪ শতাংশ। উগান্ডার ধর্মগুলির মধ্যে ইসলামই প্রথম আগমন করেছিল।১৯৭০ এর দশকে এটি রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠে। খ্রিস্ট ধর্ম মূলত ঔপনিবেশিক আমলে মিশনারীদের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে বিস্তার লাভ করেছিল। সেসময়ে উগান্ডার দক্ষিনানঞ্চলে ক্যাথলিকদের বলা হত বাফারানস (ফরাসী) এবং প্রোটেস্ট্যান্টস ব্যাঞ্জেরেজা (ব্রিটিশ)। খ্রিস্ট ধর্মের এই দুটি শাখার অনুগামীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমনকি শত্রুতা আজও আজও বেঁচে আছে। তবে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রয়েছে।
উগান্ডার মসজিদ
উগান্ডা দেশটি মসজিদের জন্য আফ্রিকা মহাদেশে বিখ্যাত একটি দেশ। উগান্ডায় অনেক বড় বড় মসজিদ রয়েছে। পূর্ব আফ্রিকার সব থেকে বড় মসজিদ
“গাদ্দাফি জাতীয় মসজিদ” উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় অবস্থিত। এ মসজিদের মিনার দেখলে মনে হয় যেন প্রায় আকাশ ছুঁয়েছে। এই মসজিদটি উগান্ডার জাতীয় মসজিদ হিসেবে খ্যাত। ২০০৬ সালে মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ২০০৭ সালে চালু করা হয়।
গাদ্দাফি মসজিদে একসঙ্গে প্রায় ১৫ হাজারের বেশি মুসলিম নামাজ আদায় করতে পারে। উগান্ডার এই মসজিদের নাম রাখা হয়েছে লিবিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফির নামে। গাদ্দাফি মসজিদ লিবিয়ার পক্ষ থেকে উগান্ডার মুসলিম জনসংখ্যার জন্য উপহার হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। গাদ্দাফির পতনের পর এ মসজিদকে জাতীয় মসজিদ নাম দেওয়া হয়েছে।
উগান্ডার অর্থনীতি
উগান্ডার অর্থনীতি মূলত কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ কৃষি পেশায় জড়িত। উগান্ডার আবহাওয়া বিশেষত প্রাণিসম্পদ এবং ফসল উৎপাদন উভয়ের জন্যই অত্যন্ত ভাল। উগান্ডা কলা ও আনারস উৎপাদনে পৃথিবীর অন্যতম সেরা দেশ। বেশিরভাগ আফ্রিকান দেশগুলির মত উগান্ডার অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আধুনিকায়ন দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দ্বারা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছিল। উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিন ও মিল্টন ওবোট সরকার অর্থনীতিতে যে ক্ষতিসাধন করেছেন তা সারানোর জন্য প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগের প্রয়োজন ছিল। ১৯৯১ সালে বিনিয়োগের আইন পরিবর্তন করে কর মওকুফসহ নানা উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে উগান্ডায় বিনিয়োগ করা অনেক সহজ।
উগান্ডার আইন ও সরকারব্যবস্থা
উগান্ডার সরকারব্যবস্থা মূলত রাষ্ট্রপতি শাসিত। রাষ্ট্রপতি একইসাথে রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধান। রাষ্ট্রপতি তাকে শাসনকালে সহায়তা করার জন্য একজন সহ-রাষ্ট্রপতি এবং একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। এছাড়া বিভিন্ন ভাগে এদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। উগান্ডার আইন আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম কঠোর ও শক্তিশালী আইন। উগান্ডার সামরিক বাহিনীকে বেশিরভাগ সময়ে ভারী অস্ত্রসহ টহল দিতে দেখা যায়। তবে উগান্ডার সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে ক্রসফায়ার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অনেক সংবাদ পাওয়া গেছে।
উগান্ডার মানুষের জীবনাচারণ
উগান্ডার বেশিরভাগ মানুষ মূলত নিরীহ ও সহজসরল স্বভাবের। এরা যেকোনো মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করে এবং দ্রুত সবার সাথে মিশে যেতে পারে। উগান্ডার মানুষ অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। ফলে পর্যটনের জন্য উগান্ডা নিরাপদ একটি দেশ। উগান্ডার বেশিরভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। এদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভুট্টা ও কলা। উগান্ডার বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে পরিবার-প্রথা চালু থাকলেও বিবাহ ববহির্ভূত যেকোনো সম্পর্ককে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ফলে উগান্ডার মেয়েদেরকে অহরহ পতিতাবৃত্তিতে দেখা যায়। উগান্ডার পতিতাদের নিয়ে সারা বিশ্বে বিভিন্ন মিথ প্রচলিত থাকায় অনেক পর্যটক সে উদ্দেশ্য পূরনেও এখানে আসে। উগান্ডার পতিতাদের চাহিদাও আকাশ্চুম্বী। অর্থাৎ উগান্ডার সামাজিক জীবনাচারণ তাদের প্রকৃতির মতই অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়।
উগান্ডার ভিসা
প্রকৃতপক্ষে উগান্ডা অত্যন্ত সুন্দর একটি দেশ। এদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে উগান্ডা ভ্রমনের কোনো বিকল্প নেই। পর্যটন খাতকে উৎসাহিত করতে বর্তমানে উগান্ডার ভিসা প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ করা হয়েছে। এখানে বেড়াতে যেতে চাইলে উগান্ডা বিমানবন্দরে পৌঁছে অন- এরাইভাল ভিসার জন্য আবেদন করা যাবে। ভিসা ফি মাত্র পঞ্চাশ মার্কিন ডলার।
আপনি উগান্ডার অসাধারন কিছু হৃদ, বৈচিত্র্যময় জীববৈচিত্র্য ও পাহাড়ি অরণ্য দেখে যতটা না মুগ্ধ হবেন, তার থেকে অনেক বেশি মুগ্ধ হবেন সেখানকার মানুষের ব্যবহারে। উগান্ডার মানুষের সদা হাসিমুখ আর পরোপকারী মনোভাবের প্রশংসা আপনাকে করতেই হবে। বাংলাদেশের সাথেও উগান্ডার সৌহার্দ্যপূর্ন রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বজায় রয়েছে৷ বাংলাদেশের বহু ব্যবসায়ী উগান্ডায় জমি ইজারা নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে বাংলাদেশের মানুষদের জন্য উগান্ডা ভ্রমণ এখন অত্যন্ত সহজ।
দারিদ্র-পীড়িত উগান্ডা একটি অপরূপ সৌন্দর্যের দেশ। নানাক্ষেত্রে বিশ্বে হাস্যরসের সৃষ্টি করলেও উগান্ডার মানুষের চওড়া হাসিমুখ নিশ্চিতভাবেই সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষের কাছে সৌন্দর্যের আধার হয়ে থাকবে।