গল্প কে না পছন্দ করে? সাহিত্যের পাতা থেকে শুরু করে অবসরে নানি দাদীদের বলা কল্প-কাহিনী, সবখানেই ছোট গল্পের রয়েছে বিশেষ কদর। আজ এই ছোট গল্প নিয়েই কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই, এই লেখার আলোচনার বিষয়- “ছোট গল্প লেখার নিয়ম”। ছোট গল্প লেখা নিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনার পাশাপাশি এখানে উল্লেখ করা হবে, ছোট গল্প লেখার বিশেষ কিছু টিপস।
কথার ফুলঝুরি ফুটিয়ে আর আগা গোঁড়া টান টান উত্তেজনা মাখিয়ে গল্পের আসর জমাতে পারে এমন লোক অহরহ থাকলেও সে গল্প সাজিয়ে গুছিয়ে শব্দে রুপায়িত করতে পারে এরকম লোক কিন্তু জগতে বিরল। কেননা জমিয়ে গল্প বলা এক জিনিস আর কাহিনী ফেঁদে একটা সার্থক ছোট গল্প লেখা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।
যদি সাঁজিয়ে গুছিয়ে ছোট গল্প লিখতে চান, জানতে চান ছোট গল্প লেখার নিয়ম কানুন, তাহলে একবার আকাশের দিকে চেয়ে দেখুন, আকাশ যেমন সীমাহীন, সাহিত্য তথা ছোট গল্প লেখার নিয়মও তেমন অন্তহীন।
ছোট গল্প লেখার নিয়ম গুলো কি কি ?
যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল লেখা বিষয়ক কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিতে এসে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক রোনাল্ড সুকেনিক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনটি কথা বার বার বলেছিলেন।
তাঁর কথা তিনটি ছিল-
যদি লিখতে চাও, পড়তে হবে। যদি লিখতে চাও, জীবনটাকে জানতে হবে। এবং লেখালেখির নিয়মগুলো প্রথমে নিজের মতো আয়ত্ত করে নিয়ে পরে প্রয়োজনমতো ভাঙতে হবে।
হ্যাঁ, এটা সত্য যে, ছোট গল্প লেখার কিছু নিজস্ব কলাকৌশল আছে। আর সবাই সেটা রপ্ত করতে পারে না। কিন্তু যদি প্রশ্ন করেন, কী সেই কলাকৌশল ? তবে সেটা ব্যাখ্যা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে ।
সম্প্রতি দুনিয়ার প্রতিটি লেখক একটি বিষয়ে একমত হয়ে গেছেন যে, ‘একটি সার্থক ছোট গল্প লেখার কলাকৌশল কেউ কাউকে শিখিয়ে দিতে পারে না। এগুলো নিজে নিজেই রপ্ত করে নিতে হয়।’
কাজেই একটি সৃষ্টিশীল ছোট গল্প কিভাবে লিখতে হয়, কিভাবে ঘটাতে হয় ঘটনার ঘনঘটা এবং কিভাবেই বা পাঠক মনে ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’ ভাবনাটির উদয় করতে হয়, তা হাতে কলমে শেখানো যায় না! যা করা যায় তা হলো, অভিজ্ঞতার আদান প্রদান ।
আমি আজ আমার অভিজ্ঞতার আলোকে ছোট গল্প লেখার কিছু কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।
আরও পড়ুন –
- ইবুক কি? পিডিএফ বই ডাউনলোড করার সেরা ১৩টি ওয়েবসাইট
- সাইকোলজিক্যাল ফ্যাক্টস : ১২টি মজার মনস্তাত্ত্বিক কৌশল
লিখতে হলে পড়তে হবে
আজ সকালেই যদি আপনি ভাবেন, কবি হবেন অথবা কথাসাহিত্যিক হবেন কিংবা আজকেই লিখে ফেলবেন একটি দূর্দান্ত ছোট গল্প, তবে আপনি হতাশা ছাড়া কিছুই পাবেন না।
এরকম ভাবে এগোনোর পরিবর্তে একটা প্রস্তুতি পর্বে ঢুকে পড়া প্রয়োজন। আর এই প্রস্তুতি পর্বটা হলো পড়ার। কারন লিখতে চাইলে পড়তে হবে। রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনাটা ছিল ব্যাপক, সে জন্যেই তিনি লিখে গেছেন,
“যেথা পাই চিত্রময়ী বর্ণনার বাণী
কুড়াইয়া আনি।জ্ঞানের দীনতা এই আপনার মনে
– কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পূরণ করিয়া লই যত পারি ভিক্ষালব্ধ ধনে।”
সারা জীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন যে নজরুল, স্বভাবে যিনি ছিলেন উড়ুক্কু, তিনিও কিন্তু প্রচুর পড়েছেন।
এদিকে লালন হয়তো বই পড়েননি, কিন্তু তিনি পৃথিবীটা ঠিকই পড়েছেন, পড়েছেন মানুষকে , বুঝেছেন মানুষের মন একদম তাঁর নিজের মতো করে।
কতগুলো জীবন সত্যের একটি হলো, যত বেশি পড়া, তত বেশি জানা । আপনি যদি পৃথিবীর পাঁচজন গল্পকারের পাঁচটা গল্প পড়েন, শুধু যে পাঁচ রকম জীবন আপনি দেখতে পাবেন তা নয়, ওই পাঁচ লেখকের মিল-অমিল, চিন্তাভাবনা, শৈলী, মেজাজ ও গল্প বলার ভঙ্গি সম্পর্কেও আপনি জানতে পারবেন।
কেমন হবে যদি এই পাঁচ কে আপনি পাঁচশতে নিয়ে যেতে পারেন ? তাহলে আপনার অনুভূতি আর ভিন্নতার ঝুলিটা যে কত বড় হতে পারে, তা তো সহজেই অনুমান করা যায়।
আবার কল্পনার কলকাঠি ত্বরান্বিত করতে পড়ার ভুমিকা অনন্য। কেননা, আপনি যদি বই এ পড়েন যে, গরু আকাশে ওড়ে তাহলে কিন্তু ব্যাপারটি সরাসরি আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে না, ঠিক যেমনটি টেলিভিশন দেখলে হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে আপনাকে হাত বাড়াতে হবে কল্পনার রাজ্যে, কল্পনার চোখে দেখতে হবে গরুটি ঠিক কিভাবে ডানা ঝাপটে আকাশে উড়ছে!
জীবনটাকে জানতে হবে
কেবল মাত্র ইংরেজি ভাষাকেই সাহিত্যচর্চার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এমন একজন ভারতীয় ঔপন্যাসিক মুল্ক্ রাজ আনন্দ বলেছেন, ‘হাতির দাঁতের মিনারে বসে রাস্তার জীবনকে জানা যায় না’।
সত্যি ই তো তাই ! রাস্তার জীবন মানে বাস্তব, কঠিন বাস্তব—একজন লেখককে দৃষ্টি দিতে হবে জীবনের ভেতরে। যতখানি পারা যায়, জীবনকে জানতে হবে।
জীবনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ উল্লাসের সুধা রসে সিক্ত হতে পারলেই, প্রকৃত ভাবে জীবনকে অনুধাবন করা সম্ভব। কাজেই আপনার নিজের জীবন কে যেমন অনুধাবন করতে হবে তেমনি বুঝতে হবে পারিপার্শ্বিকের সকল শ্রেণির, সকল বয়সের মানুষের বিচিত্র জীবন চক্র।
কেননা, মানুষের জীবন কে কেন্দ্র কর্রেই গড়ে উঠে একটি সার্থক ছোট গল্প। আর এজন্যেই বোধহয় বলা হয়ে থাকে সাহিত্যই সমাজের দর্পণ।
ভালো লাগতে পারে এমন কিছু –
থাকতে হবে লেখার নানান শৈলী সম্পর্কে সম্যক ধারণা
নিয়মের সৃষ্টি ভাঙ্গার জন্যই ! কথাটি উদ্ভ্রান্তের মতো শোনালেও ছোট গল্প লেখার জন্য এটি একটি অনন্য উপকরন।
ছোট গল্প লেখার নিয়ম ও নানান শৈলী সম্পর্কে আপনি যত বেশি জানবেন, তত বেশি জানবেন লেখালেখির নানা কৌশল সম্পর্কে, আর তত বেশি সে সব থেকে বেরিয়ে অথবা সে সব থেকে আলাদা নিজস্ব একটি কৌশল তৈরি করতে পারড়বেন খুব সহজেই।
অনেক কৌশল বা শৈলী সম্পর্কে ভালো ভাবে জানা হলে একটা বিকল্প অথবা সমান্তরাল কৌশল বা শৈলী নিজ থেকেও ধরা দিতে পারে। আর এই নতুন ধাঁচের লেখা লেখির কৌশলই আপনার ছোট গল্পটি কে করবে আরো বেশি নান্দনিক, আরো বেশি সার্থক এবং সকলের চেয়ে ভিন্ন।
থাকতে হবে বিস্তৃত কল্পনার জগত
খুব বড় একটা জীবন ধারার বাসনা থেকে এগোলে ছোটগল্পের কেন্দ্র পাওয়া সহজ হয়। এক্ষেত্রে আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’-গল্পের ফটিক অথবা ‘অপরিচাতা’ এর কল্যাণীর জীবন কি খুব বড়? তাহলে প্রত্যুতরে আমি প্রশ্ন করবো, বড় না হলে তাদের আমরা ভুলতে পারি না কেন? এই বড়ত্ব বস্তুর, সময় কিংবা বৈভবের নয়—এই বড়ত্ব কল্পনার।
বড় জীবন বলতে সেই কল্পনার বিষয়টি ই বোঝানো হয়ে থাকে, যা যে কোন ছোটগল্পকে একটি বড়সড় হীরকখণ্ডের মহিমা দিতে পারে।
কাজেই একটি সাার্থক ছোট গল্প লিখতে হলে কল্পনার জগৎটা তাই বিস্তৃত ও অবারিত করতে হবে।
আপনি হয়তো বলবেন, শুধু কবিদেরই কল্পনা শক্তি থাকতে হয়, ছোট গল্প লেখার নিয়ম জানতে বা লিখতে আবার কল্পনার কি দরকার ? বলে রাখা ভালো, আপনার এই ধারনাটি সঠিক নয়। সৃজনশীল সব লেখার ক্ষেত্রেই কল্পনার একটি বড় ভূমিকা আছে।
আপনি কি জানেন, পৃথিবীর প্রতিটি লেখকের মাঝে একটা বড় প্রভেদ গড়ে দেয় কল্পনাশক্তি? একজন লেখক চারদিকের জীবন দেখেন, বাস্তবকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, তারপর কল্পনার রসায়নে সেগুলোকে জারিত করেন।
তৈরি করুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
একজন সুস্থ মানসিকতার মানুষের এটা অবশ্যই জানা উচিত যে, অনুপ্রেরণা ভালো, অনুসরণ নয়, অনুকরণ তো নয়ই। প্রচুর বই পড়লে একটা লাভ হয়, অনেক অনেক অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়।
“অনুপ্রেরণা পাওয়া যতটা ভালো কোনো লেখককে অনুসরণ করা ঠিক ততটাই নিন্দনীয়।”
দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্যি যে, বর্তমান প্রজন্মের অনেক নতুন গল্পকার কে ই দেখা যায়, তারা বেশ সাবলীল ভাবেই হুমায়ুন আহমেদ কে অনুকরন করছেন। এঁদের গল্প চার-পাঁচ লাইন পড়ে রেখে দিতে হয়।
হুমায়ুন আহমেদ থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়ার অনেক কিছু আছে, তাঁর গ্রামদর্শন, জীবনপাঠ, জটিল মনস্তত্ত্ব উন্মোচন। কিন্তু ঠিক তাঁর মতো করে এসব করতে গেলে বিপত্তি ঘটবেই। তাঁর ভাষার অনুকরণ করলে কোনো দিনই একটা গণ্ডি থেকে বেরোনো যাবে না।
কাজেই, ছোট গল্প লেখার নিয়ম জানতে তথা একটি সার্থক ছোট গল্প লিখতে হলে আপনাকে তৈরি করতে হবে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। প্রতিটি ঘটনা দেখতে হবে নতুন করে নিজের মতো করে আবিষ্কার করতে হবে প্রতিটি মুহূর্ত।
নিজের লেখা ছোট গল্পের মাধ্যমে যদি পাঠকের মন জয় করতে চান, তাহলে নিজের সাবলিল দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করুন গল্পের মাধ্যমেই। আর সেই সাথে ঝেড়ে ফেলুন অনুকরণ করার মতো নিন্দনীয় প্রবণতাটি।
প্রয়োগ করুন নিজস্ব ভাষা
আমরা সবাই একই ভাষায় কথা বললেও সবারই কথা বলার ভঙ্গিটা কিন্তু এক নয়, ব্যাক্তি ভেদে, অঞ্চল ভেদে এই ভঙ্গি আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। সে রকম ছোট গল্প লেখার ক্ষেত্রেও ভাষাটা নিজস্ব হওয়াই চাই। এ জন্য অনেক বেশি ভাবতে হবে, অনেক বেশি লিখতে হবে।
একই কথা অনেকভাবে কোন উপায়ে, কোন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়, সেটি রপ্ত করতে হবে। বড় বড় লেখকেরা কীভাবে ভাষার ওপর তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন, তা যদি বোঝা যায়, কাজটা সহজ হয়। এজন্য চাই পড়া পড়া আর পড়া !
নিজেকে পাঠকের আসনে বসিয়ে ভাবুন
আপনি যে গল্পটি লিখছেন, বা লিখেছেন তার সম্পূর্ণ কাহিনি আপনার মাথায় আছে বটে, কিন্তু পাঠক এর কিছুই জানে না। সে শুধু সেটুকুই জানবে, যেটুকু আপনি লিখেছেন।
কাজেই একটি সার্থক ছোট গল্প লেখার সময় সবার আগে পাঠকের কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। সবার আগে ভাবতে হবে, আপনার লেখাটি কেউ একজন পড়ছে। একেবারে অচেনা আজানা কেউ পড়ছে।
এখন নিজেকে সেই অচেনা আজানা পাঠকের আসনে বসিয়ে আপনার লেখা গল্পটি পড়তে থাকুন, আর ভাবুন কি এই গল্পের মূলভাব। আবিষ্কার করুন গল্পের প্রতিপাদ্য মূল রহস্যটি। ঠিকঅনেকটা যেন দাবা খেলার মতো—আপনি একটা চাল দিচ্ছেন, দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড় আপনার এই চাল নিয়ে কী ভাবছে, পুরো খেলাটা সে কীভাবে দেখছে সেটাও আপনাকে ভাবতে হচ্ছে।
একটি গবেষণায় জানা গেছে, ‘অধিকাংশ লোক ভালো লিখতে পারে না কেবল এ জন্যেই যে, মনে মনে পাঠকের চোখ দিয়ে নিজের লেখাটা তারা পড়ে না বা পড়তে পারে না বলে।’
কাজেই নিজেকে পাঠকের আসনে বসিয়ে নিজের লেখাটি পড়ুন বার বার। অনুধাবন করুন পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। তবেই সম্ভব হবে একটি সার্থক ছোট গল্প রচনা করা।
শেষ কথা
ছোট গল্প লেখার নিয়ম এর প্রথম ধাপটিই হল অনুপ্রেরণা! কিন্তু মনে রাখতে হবে কোন লেখক থেকে অনুপ্রেরণা পেলেও তাকে অনুসরণ করা যাবে না, অনুকরণ তো নয়ই। কেননা অনুসরণ কখনো মূল কে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।
কাজেই এখন থেকেই পড়া শুরু করুন। পৃথিবীর প্রতিটি লেখকের বই পড়ে ফেলার মতো দুর্দান্ত একটি লক্ষ তৈরি করে ফেলুন, যতদুর সম্ভব পড়া চালিয়ে জান। সৃষ্টি করুন নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, প্রয়োগ করুন নিজস্ব ভাষা। সফলতা আপনার আসবেই।
আর হ্যা, পরিণতি যেমন ই হোক, লেখা থামাবেন না যেন!