আমরা সবাই জানি, চোখ কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন- চোখ কি? আমরা কিভাবে চোখ দিয়ে দেখতে পাই? রাতের অন্ধকারে না দেখে দিনের আলোয় কেন দেখি? চোখের ভিতরে কি এমন কি আছে যা আমাদের এই অনিন্দ্ব সুন্দর পৃথিবীটাকে অনন্ত মুগ্ধতার সাথে দেখতে ও অনুভব করতে সাহায্য করে? দুইটি চোখ না থেকে একটি হলে কি কি সমস্যা হতো? যদি এই প্রশ্নগুলো আপানাকে একটু হলেও ভাবিয়ে তোলে তবে এই লেখাটি আপনারই জন্য। বিস্তারিত জানার জন্য লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ে নিন।
দুই অক্ষরের ছোট্ট শব্দ চোখ। কিন্তু চোখের গঠন বেশ জটিল। বিভিন্ন অংশ নিয়ে গঠিত হয় এই ছোট্ট চোখটি। আসুন প্রথমেই জেনে নিই-
চোখ কি (What is Eye)?
আমাদের চোখ একটি আলোক-সংবেদনশীল অঙ্গ যা আলোকের মাধ্যমে দৃষ্টি সঞ্চার করে। এই চোখ মানুষের মাথার দুইপাশের বহিঃকর্ণ ও নাসারন্ধ্রের প্রায় মধ্যবর্তী অংশে অবস্থিত। প্রাণিজগতের সবচেয়ে সরল চোখ কেবল আলোর উপস্থিতি বা অনুপস্থিতির পার্থক্য করতে পারে। উন্নত প্রাণীদের অপেক্ষাকৃত জটিল গঠনের চোখগুলো দিয়ে আকৃতি ও বর্ণ পৃথক করা যায়।
চোখের গঠনঃ চোখের ১/৬ ভাগ বাইরে উন্মোচিত, বাকি আনুষঙ্গিক অংশ কোটার ভিতরে অবস্থিত। মানুষের চোখ প্রধানত দুইভাগে বিভক্ত। একটি হলো অক্ষিগোলক, অপরটি আনুষঙ্গিক অংশ।
অক্ষিগোলকের অংশগুলি হলোঃ স্ক্লেরা, কর্নিয়া, কোরয়েড, রেটিনা, সিলিয়া, আইরিশ, পিউপিল, রড কোষ, কোণ কোষ।
আনুষঙ্গিক অংশগুলো হলোঃ অক্ষিকোটর, অক্ষিপেশি, নেত্রপল্লব, অক্ষিপক্ষ, কনজাংটিভা, অক্ষিগ্রন্থি।
অক্ষিগোলক ও আনুষঙ্গিক অংশ নিয়ে বিস্তারিত নিচে দেওয়া হয়েছে।
অক্ষিগোলক (Eye-ball): চোখের কোটরের মধ্যে অবস্থিত এর গোলাকার অংশকে অক্ষিগোলক বলে। এর সামনে ও পিছনের অংশ খানিকটা চ্যাপ্টা। এটি চোখের কোটরের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সীমার চারদিকে ঘুরতে পারে।
কর্নিয়া (Cornea): এটি শ্বেতমণ্ডলের সামনের অংশ। এটি খুবই স্বচ্ছ পর্দা।
শ্বেতমণ্ডল (Sclerotic): এটি শক্ত, সাদা, অস্বচ্ছ তন্তু দিয়ে তৈরি অক্ষিগোলকের বাইরের আবরণ। এটি চোখের আকৃতি ঠিক রাখে। বাইরের নানা প্রকার অনিষ্ট থেকে চোখকে রক্ষা করে।
কৃষ্ণমণ্ডল (Choroid): শ্বেতমণ্ডলের ভিতরের গায়ে কালো রঙের একটি আস্তরণ থাকে যাকে কৃষ্ণমণ্ডল বলে। এই কালো আস্তরণের জন্য চোখের ভিতরে অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন হয় না।
আইরিস (Iris): কর্নিয়ার ঠিক পিছনে অবস্থিত একটি অস্বচ্ছ পর্দাকে আইরিস বলে। আইরিসের রং বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন রকমের হয়।
সাধারণত এর রং কালো, হালকা নীল বা গাঢ় বাদামী হয়। আইরিস চক্ষু লেন্সের উপর আপতিত আলোর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।
চোখের মণি ও তারারন্ধ্র (Pupil): আইরিসের মাঝখানে একটি ছোট ছিদ্র থাকে। একে চোখের মণি বা তারারন্ধ্র বলে। তারারন্ধ্রের মধ্য দিয়ে আলো চোখের ভিতরে প্রবেশ করে।
চক্ষুলেন্স (Eye Lens): চোখের মণির ঠিক পিছনে অবস্থিত এটি চোখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি স্বচ্ছ জৈব পদার্থের তৈরি।
লেন্সের পিছনের দিকের বক্রতা সামনের দিকের বক্রতার চেয়ে কিছুটা বেশি। লেন্সটি অক্ষিগোলকের সাথে সিলিয়ারি মাংসপেশি ও সাসপেন্সরি লিগামেন্ট দ্বারা আটকানো থাকে।
এই মাংসপেশি ও লিগামেন্টগুলোর সংকোচন ও প্রসারণের ফলে চক্ষু লেন্সের বক্রতা পরিবর্তিত হয় ফলে লেন্সের ফোকাস দূরত্বের পরিবর্তন ঘটে। দূরের বা কাছের জিনিস দেখার জন্য চক্ষু লেন্সের ফোকাস দূরত্বের পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়।
রেটিনা (Retina): চক্ষু লেন্সের পেছনে অবস্থিত অক্ষিগোলকের ভিতরের পৃষ্ঠের গোলাপী রঙের ঈষদচ্ছ আলোক সংবেদন আবরণকে রেটিনা বলে।
এটি রড ও কোন (rods & cones) নামে কতগুলো স্নায়ুতন্তু দ্বারা তৈরি। এই তন্তুগুলো চক্ষু স্নায়ুর সাথে সংযুক্ত থাকে। রেটিনার উপর আলো পড়লে তা ঐ স্নায়ুতন্তুতে এক প্রকার উত্তেজনা সৃষ্টি করে ফলে মস্তিষ্কে দর্শনের অনুভুতি জাগে।
অ্যাকুয়াস হিউমার ও ভিট্রিয়াস হিউমার (Aqueous humour and Vitreous humour): কর্নিয়া ও চক্ষু লেন্সের মধ্যবর্তী স্থান যে স্বচ্ছ লবণাক্ত জলীয় পদার্থে পূর্ণ থাকে তাকে অ্যাকুয়াস হিউমার বলে।
রেটিনা ও চক্ষু লেন্সের মধ্যবর্তী স্থান যে জেলি জাতীয় পদার্থে পূর্ণ থাকে তাকে ভিট্রিয়াস হিউমার বলে।
চোখ দিয়ে কিভাবে দেখতে পাই?
চোখ দিয়ে দেখা যতটা সহজ মনে হচ্ছে এটি ঠিক ততটা সহজও আসলে না। কিভাবে আমরা দেখি সেটা যদি একবার খুঁজে দেখা যায় তো বোঝা যাবে যে কত সূক্ষ্ম এক কারিগরি জ্ঞানে দর্শনতন্ত্র গঠিত।
কোনো বস্তু দেখার জন্য মুহুর্তের মধ্যে আমাদের চোখ ও মস্তিষ্কে কত কিছু ঘটে যায় সেটা অনুমানের অতীত। সেসব নিয়েই আসুন জানা যাক।
আমাদের চোখের গঠন এতটাই জটিল যে সেটা মাঝে মাঝে কল্পনাকে হার মানায়। চোখের কার্যপদ্ধতি অনেকটা ক্যামেরার পদ্ধতির মতই।
চোখের পাতা কাজ করে ক্যামেরার শাটারের মত, চোখের ভেতরে আছে স্থিতিস্থাপক লেন্স যা দর্শনীয় বস্তুকে ফোকাস করে এবং তারপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে একসময় তা আমরা দেখতে পাই। এই প্রক্রিয়াকরণ চলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই।
প্রতিবিম্ব ও দর্শন প্রক্রিয়ায় আমরা দেখতে পাই। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত ৫টি ধাপে সংঘটিত হয়।
চোখে আলো প্রবেশ, রেটিনায় প্রতিবিম্ব গঠন, প্রতিবিম্ব গঠনকারী রশ্মির বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রূপান্তর, প্রতিবিম্ব সম্পর্কে স্নায়ু অনুভূতি মস্তিষ্কে প্রেরণ, মস্তিষ্ক কর্তৃক স্নায়ু অনুভূতির বিশ্লেষন ও দর্শন।
মূলত দর্শনের গতিপথটি হলো:
আলোকরশ্মি – কর্নিয়া – অ্যাকুয়াস হিউমার – পিউপিল – লেন্স – ভিট্রিয়াস হিউমার – রেটিনা
এখানে প্রশ্ন স্বভাবতই চলে আসে যে, আমরা দেখি দুই চোখ দিয়ে। কিন্তু এক জিনিস দুটি না দেখে একটাই দেখি কিভাবে?
বাস্তবে আমরা দুইটি চোখ দিয়ে দুটি দ্বিমাত্রিক ছবিই দেখে থাকি। কিন্তু যখন দুই চোখের অপটিক স্নায়ু দিয়ে এই ছবির সিগন্যাল পাঠানো হয় মস্তিষ্কে তখন মস্তিষ্ক কিছু চতুর পদ্ধতিতে এই ছবি দুটিকে একটি ছবিতে পরিণত করে অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরী করে।
আমাদের চোখ দুটি একে অপর থেকে প্রায় দুই ইঞ্চি দূরত্বে অবস্থান করে। সুতরাং আমরা যা-ই দেখি না কেন, তা দেখতে দুই চোখের মধ্যে কিছুটা কৌণিক পার্থক্য থাকে। এই কৌণিক পার্থক্যকে বলে বাইনোকুলার ডিস্পেরিটি।
যখন কোনো বস্তু আমাদের কাছাকাছি থাকে তখনই কেবল বাইনোকুলার ডুস্পেরিটু সম্ভব। কিন্তু এই বাইনোকুলার দৃষ্টি ছাড়াও আরো একটি বিশেষ পদ্ধতিতে প্রাণী ত্রিমাত্রিক দৃশ্য দেখতে সক্ষম।
এই পদ্ধতিকে বলা হয় প্যারালাক্স পদ্ধতি। মূলত চলমান অবস্থায় বস্তুর সাথে আমাদের গতির তারতম্য হিসাব করেই মস্তিষ্ক কোনো বস্তুর অবস্থান কিংবা আকৃতির ত্রিমাত্রিক ছবি প্রস্তুত করতে সক্ষম।
এখন দুই চোখের দেখা দুটি দ্বিমাত্রিক ছবি প্রথমে আন্তঃনিউরন পথে গ্যাংলিওন নামক নিউরন কোষে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে প্রতিটি রেটিনা এই সংকেত বা তথ্যকে ডান ও বাম এই দুই অংশে ভাগ করে এবং এরা মস্তিষ্কে এদের বিপরীত অংশে প্রবেশ করে।
নিউরন মস্তিষ্কে প্রবেশের আগে এই দুই প্রকার ছবির মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য করে এবং প্রয়োজনে কিছু তথ্য ফিল্টার করে ফেলে।
এই ফিল্টারিং ছবির কন্ট্রাস্ট এবং ডেফিনিশনকে আরো সহজবোধ্য করে তোলে। তারপর নিউরন থেকে এই সংকেত চলে যায় অপটিক স্নায়ুতে এবং শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কে।
মস্তিষ্কের থ্যালামাস অঞ্চল দিয়েই এই সিগন্যাল মস্তিষ্কের প্রবেশ করে। থ্যালামাস অঞ্চলটি এই সিগ্ন্যালকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে। প্রথম অংশে থাকে বর্ণ ও অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য এবং অপর অংশে থাকে বস্তুর গতি সম্পর্কিত তথ্য ও কন্ট্রাস্ট।
দুই চোখের দুটি অপটিক স্নায়ু যখন মস্তিষ্কে প্রবেশ করে তখন এরা একে অপরকে আড়াআড়িভাবে অতিক্রম করে এবং ‘অপটিক কায়াজম’ নামক একটি বিন্দুতে মিলিতি হয়।
এখানে প্রতিটি চোখের বাম পাশ থেকে প্রাপ্ত সিগন্যাল মস্তিষ্কের বাম পাশে প্রবেশ করে এবং ডান পাশ থেকে প্রাপ্ত সিগন্যাল প্রবেশ করে মস্তিষ্কের ডান পাশে। এরপর এই দুই প্রকার সিগন্যাল মিলিত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক সিগন্যাল গঠিত হয়।
কালার ভিশন যেভাবে কাজ করে?
আমরা কিভাবে কোনো বস্তুর বর্ণ দেখি সেটা বেশ মজার একটি বিষয়। আমাদের চারপাশে নানা আকৃতির, নানা বর্ণের কতশত বস্তুই আছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে যে আমরা আসলে কিভাবে সেসব বর্ণের উপলব্ধি করি?
কোনো বস্তুর উপর যখন আলো আপতিত হয় তখন আপতিত আলোর কিছু অংশ বস্তুটি শোষণ করে এবং বস্তুটি প্রকৃতপক্ষের যে বর্ণ ধারণ করে সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো প্রতিফলিত করে।
এই প্রতিফলিত আলো যখন আমাদের চোখে এসে আঘাত করে তখন সেটি আবার মস্তিষ্কে প্রেরণ করা হয় এবং আমরা দেখতে পাই। বিষয়টি একটু বিস্তারিত জানা যাক।
বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলো প্রথমে আমাদের চোখে প্রবেশ করে। কি পরিমাণ আলো আমাদের চোখে প্রবেশ করে তা নির্ভর করে আমাদের আইরিশের ভেতর অবস্থিত উজ্জ্বল ও বৃত্তাকার কিছু পেশীর নিয়ন্ত্রণের উপর।
এই পেশীগুলোর সংকোচন ও প্রসারণের কারণেই আমাদের চোখের পিউপিলের আকৃতির পরিবর্তন হয়। প্রথমে আলোকরশ্মি কর্নিয়া নামক একপ্রকার অনমনীয় ও রক্ষণশীল পর্দার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করে।
তারপর প্রবেশ করে চোখের লেন্সের ভেতর দিয়ে। চোখের লেন্সটি আবার স্থিতিস্থাপক। অর্থাৎ বস্তুর অবস্থান, আকৃতি কিংবা এর আলোকীয় বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে চোখের লেন্সের ফোকাল লেংথ এবং ফোকাসিং পরিবর্তিত হয়।
এরপর আলোকরশ্মি আপতিত হয় চোখের পেছন দিকে রেটিনা নামক অঞ্চলে। রেটিনা অঞ্চল মূলত রড ও কোন নামক দুই ধরনের আলোক সংবেদী কোষ দ্বারা নির্মিত।
প্রতিটি আলোক সংবেদী কোষ কতিপয় পিগমেন্ট কণা ধারণ করে। যখন আলো আপতিত হয় তখন এই পিগমেন্ট কণাগুলোর আকৃতি পরিবর্তন হয় এবং সে অনুযায়ী সিগন্যাল তৈরী হয়।
রড কোষগুলো আলোর প্রকৃতি শনাক্তকরণ করে আর কোন কোষগুলো আলোর বর্ণ শনাক্তকরণ করে এবং সেই অনুযায়ী মস্তিষ্কে সিগন্যাল প্রেরণ করে।
আমরা আমাদের চারপাশে যা-ই দেখি তা সাধারণত বিভিন্ন বর্ণের হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে আমাদের চোখ তিন ধরনের আলোক তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে অর্থাৎ লাল, নীল এবং সবুজ রঙ শনাক্ত করতে পারে এবং এই তিন বর্ণের সিগন্যালের সমন্বয়ে মস্তিষ্কে গঠিত হয় লক্ষ লক্ষ যৌগিক বর্ণ।
এখন আলো যখন বস্তু থেকে প্রতিফলিত হয় তখন সেই প্রতিফলিত আলো আমাদের চোখে এসে আঘাত করে। আমাদের প্রতিটি চোখই প্রায় ছয় থেকে সাত মিলিয়ন কোন কোষ ধারণ করে।
এই কোন কোষ গঠিত হয় অপ্সিন নামক বর্ণ সংবেদনশীল প্রোটিন দিয়ে। যখন আলোর ফোটন কণা অপ্সিনে এসে আঘাত করে তখন কোন কোষগুলো আলোর মাত্রা অনুযায়ী আকৃতি পরিবর্তন করে। সেই সাথে তৈরী করে তড়িৎ সংকেত যা অপটিক স্নায়ু মারফত প্রবাহিত হয় আমাদের মস্তিষ্কে।
মূলত মস্তিষ্কের ভিজুয়াল কর্টেক্স অঞ্চলে এই সিগন্যাল প্রেরিত হয় এবং এখানে প্রক্রিয়াকরণের পরই মূল বর্ণ হিসেবে ধরা দেয় আমাদের চোখে।
গবেষকদের মতে, কোন কোষগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই (মতান্তরে ৬৪ শতাংশ) লাল রঙের প্রতি সংবেদনশীল, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সবুজ রঙের প্রতি এবং মোটামুটি ২ শতাংশ কোন কোষ নীল রঙের প্রতি সংবেদনশীল।
এই তিন প্রকার বর্ণ সংবেদনশীল কোষই তিন প্রকার বর্ণের সমন্বয়ে তৈরী করে অজস্র বর্ণের। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে এই বর্ণের সীমা বর্ণালীর হলুদ থেকে সবুজ অংশের মধ্যেই সীমিত।
কোন কোষগুলো বেশিরভাগই চোখের রেটিনার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থান করে। রেটিনার এই কেন্দ্রীয় অঞ্চলটি মিলিমিটারের ভগ্নাংশের সমতুল্য (মতান্তরে প্রায় .৩ মিলিমিটার) একটি বিন্দুর ন্যায় এবং এটি ফোভিয়া নামে পরিচিত।
আলো এই ফোভিয়া নামক বিন্দুতে যখন ফোকাস হয় তখন মূল রঙিন ছবিটি আমাদের দর্শনকেন্দ্রে প্রতিভাত হয়। রেটিনার বাকি অংশ জুড়ে থাকে প্রায় ১২০ মিলিয়ন রড কোষ।
চোখের উপযোজন: একটি উত্তল লেন্সের সামনে ফোকাস দূরত্বের বাইরে কোনো বস্তু রাখলে লেন্সের পিছনে বস্তুটির একটি বাস্তব প্রতিবিম্ব গঠিত হয়।
লেন্সের পিছনে একট পর্দা রাখলে পর্দার উপর বস্তুটির একটি উল্টো প্রতিবিম্ব দেখা যায়। পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে পর্দাটির একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে প্রতিবিম্ব সবচেয়ে পরিষ্কার হয়।
একটি বস্তুকে যদি লেন্সের নিকটে আনা হয় বা লেন্স থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে পরিষ্কার প্রতিবিম্ব পাওয়ার জন্য পর্দাটিকে সামনে বা পিছনে সরাতে হয়।
এখন আমরা যদি পর্দার পূর্ব অবস্থানে পরিষ্কার বিম্ব পেতে চাই তাহলে ভিন্ন ফোকাস দূরত্বের লেন্স ব্যবহার করতে হবে।
চোখের ক্ষেত্রে ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটে। কর্নিয়া, অ্যাকুয়াস হিউমার, চক্ষু লেন্স ও ভিট্রিয়াস হিউমার একত্রে একটি অভিসারী লেন্সের কাজ করে।
চোখের সামনে কোনো বস্তু থাকলে সেই বস্তুর প্রতিবিম্ব যদি রেটিনার উপর পড়ে তাহলে মস্তিষ্কের দর্শনের অনুভূতি জাগে এবং আমরা সেই বস্তু দেখতে পাই।
আমরা চোখের সাহায্যে বিভিন্ন দূরত্বের বস্তু দেখি। চোখের লেন্সের একটি বিশেষ গুণ হচ্ছে এর আকৃতি প্রয়োজন মতো বদলে যায় ফলে ফোকাস দূরত্বের পরিবর্তন ঘটে।
ফোকাস দূরত্বের পরিবর্তনের ফলে লক্ষবস্তুর যে কোনো অবস্থানের জন্য লেন্স থেকে একই দূরত্বে অর্থাৎ, রেটিনার উপর স্পষ্ট বিম্ব গঠিত হয়।
যে কোনো দূরত্বের বস্তু দেখার জন্য চোখের লেন্সের ফোকাস দূরত্ব নিয়ন্ত্রণ করার এই ক্ষমতাকে চোখের উপযোজন বলে।
স্পষ্ট দর্শনের ন্যূনতম দূরত্ব: আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাই যে কোনো বস্তুকে চোখের যত নিকটে নিয়ে আসা যায় বস্তুটিও তত স্পষ্ট দেখা যায়।
কিন্তু কাছে আনতে আনতে এমন একটা দূরত্ব আসে যখন আর বস্তুটি খুব স্পষ্ট দেখা যায় না। যে ন্যূনতম দূরত্ব পর্যন্ত চোখ বিনা শ্রান্তিতে স্পষ্ট দেখতে পায় তাকে স্পষ্ট দর্শনের ন্যূনতম দূরত্ব বলে।
স্বাভাবিক চোখের জন্য স্পষ্ট দর্শনের ন্যূনতম দূরত্ব প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার। চোখ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার দূরবর্তী বিন্দুকে চোখের নিকট বিন্দু বলে। কোনো বস্তু ২৫ সেন্টিমিটারের কম দূরত্বে থাকলে তাকে স্পষ্ট দেখা যায় না।
সবচেয়ে বেশি যে দূরত্বে কোনো বস্তু থাকলে তা স্পষ্ট দেখা যায় তাকে চোখের দূরবিন্দুও বলে। স্বাভাবিক চোখের জন্য দূরবিন্দু অসীম দূরত্বে অবিস্থত হয়। অর্থাৎ স্বাভাবিক চোখ বহুদূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পায়।
দর্শনানুভূতির স্থায়িত্বকাল: চোখের সামনে কোনো বস্তু রাখলে রেটিনায় তার প্রতিবিম্ব গঠিত হয় এবং আমরা বস্তুটি দেখতে পাই।
এখন যদি বস্তুটিকে চোখের সম্মুখ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে সরিয়ে নেওয়ার ০.১ সেকেন্ড পর্যন্ত এর অনুভূতি মস্তিষ্কে থেকে যায়। এই সময়কে দর্শনানুভুতির স্থায়িত্বকাল বলে।
দু’টি চোখ থাকার সুবিধা কি?
দু’টি চোখ দিয়ে একটি বস্তু দেখলে আমরা কেবলমাত্র একটি বস্তুই দেখতে পাই। যদিও প্রত্যেকটি চোখ আপন আপন রেটিনায় প্রতিবিম্ব গঠন করে, কিন্তু মস্তিষ্ক দুটি ভিন্ন প্রতিবিম্বকে একটি প্রতিবিম্বে পরিণত করে। দুটি চোখ থাকার জন্য দূরত্ব নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা যায়।
তাই একটি চোখ বন্ধ রেখে সুইয়ে সুতা পরাতে খুবই অসুবিধা হয়। তাছাড়া বস্তুর তুলনায় দুটি চোখের বিভিন্ন অবস্থানের জন্য ডান চোখ ডান দিকটা বেশি এবং বাম চোখ বাম দিকটা বেশি দেখে।
দুই চোখ দিয়ে বস্তু দেখলে দু’টি ভিন্ন প্রতিবিম্বের উপরিপাত ঘটবে এবং বস্তুকে ভালোভাবে দেখা যাবে।