আজ আমরা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব তা হচ্ছে- সর্দি, কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও সর্দিজনিত মাথাব্যথা নিরাময়ের জন্য কার্যকর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি।
ঠান্ডা লেগে নাক দিয়ে অথবা ক্ষেত্রবিশেষে চোখ দিয়ে পানি পরার অবস্থাকে সাধারণভাবে সর্দি বলা হয়। সর্দি ও ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রধানত ভাইরাসের সংক্রমণজনিত কারণে হয়ে থাকে।
এটা বিভিন্নভাবে শরীরের অন্যান্য অঙ্গকেও প্রভাবিত করে থাকে। যেমন- সর্দি জনিত কারণে অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর সর্দির সাথে একত্রিতভাবে প্রচন্ড মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা প্রভৃতির সৃষ্টি হয়।
তবে সর্দির দ্বীতিয় অবস্থায় সাধারণত গলা আক্রান্ত হয়। তখন যে সমস্যাগুলো হয় তাদের মধ্যে স্বরযন্ত্র প্রদাহ বা ল্যারিঞ্জাইটিস ও গলনালীপ্রদাহ বা ফ্যারিঞ্জাইটিস প্রধান।।
অনেক দিন ধরে সর্দি ঝঁড়লে নাকের শ্লেষ্মা ঝিল্লীতে ও চোখের পাতায় চুলকানি হতে পারে। এতে করে আক্রান্ত অংশ গোলাপী বা লালচে রং ধারণ করে ফুলে যেতে দেখা যায়। পরবর্তীতে তা ঘা সৃষ্টি করে ক্ষতকারী হয়ে উঠে।
সাধারণ এলার্জি সর্দির লক্ষণসমূহ
নাকের মিউকাস ঝিল্লি ও ন্যাসোফ্যারিংসে সংক্রমণের কারণে নাক থেকে তরল পানি ঝঁরতে থাকে ও হাঁচি হতে থাকে। সামান্য ঠান্ডা লাগলেও পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। ফলে মাথা ব্যথা ও মাথা ঘুরতে থাকে।
এই অবস্থায় বিভিন্ন প্রকার ম্যালাইস এবং পাইরেক্সিয়া উৎপন্ন হয়। যার ফলে এলার্জি কাশির সৃষ্টি হয়।
রেসপাইরেটরি মিউকাস মেমব্রেন এর কোনো এক অংশে খুসখুস করার কারণে রিফ্লেক্স অ্যাকশনের কারণস্বরূপ কাশি তৈরি হয়। এই কাশি শুকনো, নরম অথবা শ্লেষ্মাযুক্ত হতে পারে।
গুরুতর এই অসুস্থতাটি দুটি কমন টাইপ এ ও বি মাইক্সোভাইরাস এর গ্রুপ দ্বারা ঘটে থাকে। এর লক্ষণটি হল পাইরেক্সিয়ারের সূত্রপাত- যার ফলে মাথার যন্ত্রণা, এ্যানোরেক্সিয়া, বমি বমি ভাব, বমি ইত্যাদি হয়ে থাকে।
এর ভাবীফল স্বরূপ কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর লক্ষণসমূহের সৃষ্টি হতে পারে। ভয়ানকভাবে কাশি হয়, যা নিয়ন্ত্রণ বা নিরাময় করার ক্ষেত্রে অনেক সময় যথেষ্ঠ বেগ পেতে হয়।
ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি জনিত মাথাব্যথা ও এলার্জি সর্দির হোমিও ঔষধ
অ্যাকোনাইট নেপেলাস
জ্বরের কারণে শারীরিক ও মানসিক অস্থিরতা ও দুর্বলতা অনুভব করলে, ঠান্ডা হাওয়ায় খুব শীত করলে অথবা ঠান্ডা হাওয়ার কারণে শরীরে শুষ্কতা অনুভব করার কারণে মানসিক অবসাদ আসে। ঘ্রাণ নিতে অসুবিধা হয়। নাকের গোড়া ব্যথা করে। মিউকাস মেমব্রেণ শুকিয়ে যায়। গরম সর্দি ঝড়ে। গলা লাল হয়ে ধরে যায় বা বসে যায়।
আর্সেনিক এলবাম
আর্সেনিক এলবাম সাধারণত সর্দির পুরাতন বা ক্রনিক অবস্থার ওষুধ। তবে অনেক সময় তরুন সর্দি চিকিৎসায়ও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়।
লক্ষণসমূহ হচ্ছে- সর্দির তরুন অবস্থায় নাক দিয়ে তরল সর্দি ঝড়ে ও নাকের ভেতরটা বিশেষত যে স্থানে সর্দির স্পর্শ লাগে সেখানটায় জ্বালা করে। অর্থাৎ- আর্সেনিক এলবাম এর সর্দি ক্ষতকারী হয়ে থাকে। রোগী ঠান্ডা আবহাওয়া, ঠান্ডা পানি ও প্রবাহিত শীতল বায়ুতে অসুস্থ বোধ করে ও অপেক্ষাকৃত গরম আবহাওয়ায় ভালো বোধ করে।
জেলসেমিয়াম
এটি মাংসপেশীর দুর্বলতার উপর কাজ করে। এই ওষুধের প্রধান লক্ষণসমূহ হচ্ছে মাথা ঘোরা, মাথা ভারী লাগা, হঠাৎ মাথাব্যথা, সারা মাথাটা খুব শক্ত বোধ হওয়া, চোখের চারপাশে ভারী ও ব্যথা করা, প্রভৃতি। তন্দ্রাভাব ও শীতবোধ হয়। বিশেষত গরমের দিনে জেলসেমিয়ামের রোগী বেশী দেখা যায়।
এছাড়াও হাঁচি আসে। নাক বন্ধ থাকে ও নাকের গোড়ায় ফুলনেস বোধ হয় এবং নাক শ্লেষ্মায় ভরে যায়। গুরুতর কোরাইজার পরিস্থিতিতে মাথাব্যথা, জ্বর, শুকনো কাশি, বুকে প্রদাহ ইত্যাদি অবস্থায় ও কার্যকরী। এই ওষুধ গ্লটিসের স্প্যাজমকেও নিরাময় করে।
শুকনো সর্দি ও কাশি চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শ্রেষ্ঠ হোমিও ওষুধ
ব্রায়োনিয়া এলবাম
ব্রায়োনিয়ার সর্দি শুকনো হতে দেখা যায়। এতে শরীরের সমস্ত মাংসপেশীতে ব্যথা থাকে। মিউকাস মেমব্রেণ শুকিয়ে যায়। শুকনো কাশি হয়। রিউমেটিক ব্যথা ও ফোলা দেখা যায়। শরীর দুর্বল লাগে। মেজাজ খিটখিটে থাকে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হয় যা সামান্য নড়াচড়ায় প্রচন্ড বৃদ্ধি পায়। এমনকি চোখের মনি পর্যন্ত ব্যথা করে। মুখ, জিভ ও গলা শুকিয়ে যায়। অতিরিক্ত পিপাসা লাগে।
ল্যারিন্স ও ট্রাকিয়া প্রচন্ড ব্যথাসহ টাটিয়ে থাকে ও ফুলে যায়। গলা শুকিয়ে বসে যায়। ট্রাকিয়ার ওপরভাগে অস্বস্থির কারণে শুকনো কাশি হতে থাকে। সারারাত বসে বসেই কাটাতে হয়। কিছু খাওয়ার বা পান করার পর অবস্থা আরো অবনতির দিকে যায়।
বুকের মধ্যে কি যেন বিঁধছে এমন মনে হয়। এই সমস্ত সমস্যার সমাধান বা নিয়ন্ত্রণের জন্য এই ওষুধটি বিশেষ কার্যকরী।
ইউপেটোরিয়াম পারফোলিয়েটাম
এটি ফেব্রাইল রোগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং তার প্রভাবসহ মাথাব্যথা, হাড়ে ব্যথা, মাংসপেশী ও হাড় ফুলে যাওয়ার মত লক্ষণসমূহের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এছাড়া কোরাইজা এবং হাঁচি আসা, কফ, বুকে প্রদাহ সহ কাশি ও তার জন্য জ্বর ও পিপাসা লাগা – এই সমস্যাগুলোর জন্য এই ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী।
নাক্স ভমিকা
সর্দিতে নাক সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে (বিশেষত রাতের বেলা ও নবজাত শিশুদের) নাক্স ভমিকা কার্যকরী। এর প্রধান লক্ষণসমূহ হচ্ছে- রাতের বেলা সর্দি শুকনো অপরদিকে দিনের বেলা সর্দি গাঢ় হয়। মাথা ভার থাকে। সকালের দিকে লক্ষণসমূহের বৃদ্ধি ঘটে।
পুরাতন সর্দি কাশি চিকিৎসা’য় ব্যবহৃত প্রধান হোমিওপ্যাথিক ওষুধসমূহ
ডালকামারা
বর্ষাকালে সর্দির পক্ষে ডালকামারা একটি শ্রেষ্ঠ ওষুধ। এছাড়া যাদের প্রতি বর্ষাতে প্রায়ই সর্দি হতে দেখা যায় এবং সহজে ভালো হতে চায়না, বরং ক্রনিক বা পুরাতন সর্দিজনিত লক্ষণসমূহের বিকাশ ঘটায় তাদের চিকিৎসায় ডালকামারা একটি মনে রাখার মত ওষুধ বটে।
মার্ক সল
হলুদ রঙের পুঁজের মত গাঢ় শ্লেষ্মা, গলা ও গলার গ্রন্থিগুলো স্ফীত হওয়া লক্ষণে মার্কসল ভাল কাজ করে।
অরাম মেট
উপদংশ জনিত সর্দিতে অরাম মেট উপকারী। অরাম মেট এর রোগীদের নাকে পুরাতন সর্দির ক্ষতকারী প্রভাবের কারণে প্রায়ই ঘা হতে দেখা যায়। এমনকি সেই ঘা পরবর্তীতে নাকের অস্থি পর্যন্ত আক্রমণ করে অস্থি বিকৃতি বা পচন ঘটাতে পারে।
পালসেটিলা
পালসেটিলার সর্দি গাঢ় পীতাভ অথবা হলুদ রং ধারণ করে। এর সর্দি সকালে সরল বা তরলভাবে সহজেই বের হয়ে আসে, কিন্তু যতই দিন গড়ায় ততই গাঢ় হতে থাকে। অবশেষে সন্ধ্যায় পূর্ণ হলুদ পাকা সর্দির রূপ নেয়। পালসেটিলার সর্দিতে আক্রান্ত রোগী কোনও প্রকার খাদ্য দ্রব্যের ঘ্রাণ বা গন্ধ পায় না।
এন্টিম টার্ট
সর্দি খুব বসে গিয়ে গলায় ও বুকে ঘড় ঘড় শব্দ করতে থাকলে এন্টিম টার্ট প্রযোজ্য হবে। এই ওষুধের লক্ষণে রোগী কাশলে মনে হয় বুকে অনেক কফ আছে। অথচ প্রচুর কাশি হলেও বিন্দুমাত্র কফ উঠে আসে না। নিম্ন শক্তি প্রয়োগে গলার ও বুকের কফ তরল হয়ে বের হয়ে আসে ও ফুসফুসে শক্তি সঞ্চারিত হয়।
কেলি বাইক্রম
বার বার প্রবল হাঁচি, অধিক পরিমানে নাক দিয়ে জল পড়া লক্ষণে কেলি বাইক্রম উপকারী। কেলি বাইক্রমের সর্দি পুরোনো হলে তা দড়ির মত লম্বা ও চটচটে হয়ে নাক থেকে ঝুঁলে পড়ে।
সাধারণত পুরাতন সর্দিতে বেশী প্রয়োজন হয়। এছাড়া কেলি বাইক্রম এর আর একটি স্বরণযোগ্য বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে- এটা নাকের শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির উপর প্রভাব বিস্তার করে তাতে পলিপাস নামক এক প্রকার স্ফীতি ঘটায়। কেলি বাইক্রম নাকের পলিপাস চিকিৎসায়ও একটি প্রধান ওষুধ বলে স্বীকৃত।
আক্ষেপযুক্ত সর্দি কাশি চিকিৎসা
ইপিকাক
এর প্রধান কার্যকারীতা ন্যুমো গ্যাস্ট্রিক নার্ভে হয়। ফলে এটি স্প্যাজম বা আক্ষেপকে রুখে দিয়ে পেট জ্বালা করা কমিয়ে দেয়। সর্দিজ অবস্থায় এর লক্ষণসমূহ হচ্ছে- কোরাইজা বা সর্দির জন্য নাক বন্ধ হয়ে যায়।
এমনকি সর্দিতে নাক বন্ধ হয়ে যাবার কারণে রাতে ঘুমানোর সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বলে রোগীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। অনবরত আক্ষেপযুক্ত কাশি উৎপন্ন করে। যে সমস্ত ক্ষেত্রে রোগী কাশতে কাশতে বমি করে দেয় বা অনবরত বমি বমি ভাব হয়, সেক্ষেত্রে বিশেষভাবে উপযোগী।
আরও পড়ুন-